বস্তির করুণ জীবনের কথকতা
ঢাকা থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
ঢাকা শহরে বস্তিবাসীদের জীবন এক ভিন্ন রকম জীবন। এই জীবনে মানুষের জীবন ও জীবিকার কোন কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। আজ এখানে তো কাল ওখানে, সকালে এক রকম তো বিকালে আরেক রকম, কখনো বৃষ্টি হলে যেমন তাদের জীবন হয়ে পড়ে উদ্বাস্তুর মতো আবার কখনো আগুণ লেগে তাদের জীবন হয়ে পড়ে সহায়, সম্বলহীন। এভাবে যেনো তেনোভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই সকল বস্তিবাসীরা নানান পেশার কাজের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। কেউ রিকসা চালায়, কেউ ছোট দোকান, কেউ হকার তো কেউ শ্রমিক। কিন্তু এই সকল কাজেরও কোন ধারাবাহিকতা নেই। আজ কাজ আছে তো কাল নেই এই হলো তাদের প্রাত্যহিক জীবন। তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার যে জীবন চক্র তা কোনভাবেই পরিবর্তিত হয় না। এককথায় বস্তির মানুষের জীবিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গার্মেন্টস শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, হকার, ছোট দোকানদার, হোটেল শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ঠেলাগাড়ী চালক, রিকসাওয়ালা, দোকান শ্রমিক, রং মিস্ত্রী, ওয়েলডিং কারখানার শ্রমিক, কুলি, গার্ড, ছোট চাকুরিজীবী প্রমূখ।
বস্তিবাসীদের একটি বড় অংশ মানুষ আসে উপকূলীয় ও নদীভাঙন প্রবল অঞ্চল থেকে। তারা তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে বেঁচে থাকার আশা নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় কোন রকমে তাদের জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের অধিকাংশ শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় কোনভাবে বসবাস করে। কিন্তু অভাব, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বন্যা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাদের পিছু ছাড়েনা। ৫ ফুট বাই ৫ ফুট ছোট্ট ঘরেই বন্দি তাদের কষ্টের জীবন।
এমনই কষ্টের কথা হচ্ছিল বেশ কয়েকজন বস্তিবাসীদের সাথে। মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার শস্তাল গ্রামের মো. শামীম (২৫) বলছিলেন তার দুঃখকথাগুলো। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। নদীর গ্রাসে তার বাড়ি হারান আর তারপরই ঢাকায় এসে আবাস গড়েন। গ্রামে ভয়াবহ অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন আর পারছিলেন না তখন ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি বলেন, “একসময় বাড়ি ছিল বিলে জমি ছিল, ছিল সুখের সংসার। আর এখন দিন এনে দিন খাই। তবুও অভাব ছাড়েনা। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছি তাই কিছু করার যোগ্যতাও নাই। প্রথমে ঢাকা এসে লেবারি করেছি ট্রাকে। আজ এই কাজ কাল সেই কাজ করে এখন রিকসা চালাই। বউ তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে ৫ জনের সংসার।” বস্তির জীবনে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,“ভাই বস্তিতে কি মানুষ ইচ্ছা কইরা থাকে। বাধ্য হয়েই এ জীবন। এখানে নেই কোন নিশ্চয়তা। আজ আগুন লাগেতো কাল বৃষ্টিতে ডুবে যায়। অসুখ বিসুখ লেগেই আছে সবদিকে। ছোট্ট একটা ঘরের ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। লাকড়ি, কারেন্ট বিল, ঔষুধ নিয়ে সবই খরচ হয়ে যায়। এ জীবনে আর কোন দিশা নাই।”
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার রাজনগর গ্রামের মো. ইয়াসিন আলী (৫৫) বলেন, “প্রায় ৮/৯ বছর আগে বউবাজার বেড়িবাঁধ এসে বসবাস শুরু করি। গ্রামে দারুণ অভাব ছিল। এই অভাব থেকে বাঁচতে ঢাকায়্ আসছি। বস্তির জীবন খুব কষ্টের। এখানে পানির জন্য মানুষে মানুষে ঝগড়া মারামারি হয়। কেউ কাউরে দেখার নাই।” তিনি আরও বলেন, “আমি ৩ ছেলে মেয়ে নিয়ে কোন রকমে দিন পার করি। আমার একটা ছেলে চাকুরি করে। আমার যা আয় তার বড় অংশ চলে যায় ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল দিতেই। ২৬০০ টাকা ঘর ভাড়া, ৫০০ বিদ্যুৎ বিল, ১২০০ লাকড়ি, সন্তানদের পড়াশুনার খরচ আরো হাজারটা খরচ। তবে গ্রামে থাকতে খেতে পারতাম না আর এখানে কাজ করলে খাবার জুটে।”
একই রকম কথা বলছিলেন নেত্রকোনার মুজিবুর রহমান (৫৫), খুলনার আব্দুল মান্নান শেখ (৪৩), ভোলার আবুল কাসেম (৩৩), নূর মোহাম্মদ বাবলু (২৫), ভোলার শামসুন্নাহার (৪৫) প্রমুখ।
বস্তির মানুষের রোগ আর ভোগান্তির শেষ নেই। নেই কোন স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা। এখানে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, পাতলা পায়খানা, চর্মরোগ, মাথাব্যথাসহ হাজারো সমস্যা লেগেই থাকে। ঢাকা শহরের প্রায় অধিকাংশ বস্তিতে সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া জ্বর হলেও সেখানে কোন ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
বস্তি মানেই অনিরাপদ জীবন। নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বস্তিতে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাদকসহ নানান ধরণের অপরাধমূলক কার্যক্রম। কিন্তু সে বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই।
বস্তি মানেই একঘরে রান্না বান্না খাওয়া ঘুম এক ঘরেই । এখানে স্বামী সন্তানদের নিয়ে এক ঘরেই নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের বসবাস করতে হয়। তাই পরিবার জীবন এখানে খুবই দ্বান্দ্বিক। দুপুর বেলা আব্দুল মান্নান শেখ (৪৩) বেড়িবাঁধের শহীদ স্মৃতিসৌধে গাছের ছায়ায় বসে কাটান। কারণ তার ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে তারা দুপুর বেলায় একই ঘরে একটু ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নেই। আর সে সময় সে স্মৃতিসৌধে কাটান।
স্কুল নেই- নেই শিক্ষার আলো। অধিকাংশ বস্তিতে স্কুল নেই। এখানে আছে নিরক্ষরতার কষ্ট। কোন রকমে নাম লিখতে পারে সামান্য কিছু মানুষজন। তাই অশিক্ষা তাদের নিত্যসঙ্গী। এই জীবন তাদের কখনই কাঙ্খিত ছিল না। কিছু কিছু বস্তিকে কেন্দ্র করে বেসরকারি কিছু স্কুল গড়ে উঠলেও নেই সেখানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এই কষ্টের মধ্যেও কেউ কেউ তাদের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চান। চাঁদ উদ্যোনের পাশে সোনা মিয়ার টেক বস্তিতে বেসরকারি সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে আনন্দ স্কুল। সেই স্কুলে দেখলাম অনেক শিশু খেলছে, আকঁছে, পড়ছে। তাদের সবারই স্বপ্ন শিক্ষিত হবে। আলোকিত মানুষ হবে।
বর্তমান সভ্যতার একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হলো এই শহুরে বস্তি জীবন। যে জীবনের দায় অনেকাংশ বর্তায় উন্নত বিশ্বের উপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় তারা আজ এই বস্তির জীবনযাপন করছে। এই জীবন থেকে মানুষকে উন্নত জীবনের পথ খুঁজে দেওয়া একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের পাশে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।