অযত্ন-অবহেলায় ৪ শ’ বছরের শ্যামসুন্দর মঠ

অযত্ন-অবহেলায় ৪ শ’ বছরের শ্যামসুন্দর মঠ

সাতক্ষীরা থেকে আসাদ রহমান:
প্রকৃতির সাথে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতে হবে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সীমান্ত জনপদ সোনাবাড়িয়া গ্রামে। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা সোনাবাড়িয়া এলাকা জুড়ে। এমনই এক পুরাকীতির নাম শ্যামসুন্দর মঠ মন্দির। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।

satkhira sonabari mothসাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে এই প্রত্নস্থলটির অবস্থান। প্রায় ৪ শ’ বছরের পুরানো ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি সংরক্ষণ করার জন্য গত ২০১২ সালে উদ্যোগ নিলেও আজও পর্যন্ত কোনো সংস্কার করা হয়নি। স্থানীয়দের দাবি দ্রুত সংস্কার করা না গেলে এই জাতীয় সম্পদটি বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শ্যামসুন্দর মঠ মন্দিরটি ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দূর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করে ছিলেন। এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর ত্রিতলবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। এটিই এলাকায় ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গা মন্দির ও শিবমন্দির।

এই মন্দির দুটির দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচের তলা ১০.৮২ মিটার (৩৫ফুট ৬ ইঞ্চি) বর্গাকার ভিত পরিকল্পনায় নির্মিত। এর দ্বিতলের মাপ দৈর্ঘ্যে ১০ মিটার (৩২ফুট ১০ ইঞ্চি.) এবং প্রস্থে ৯.৯৮ মিটার (৩২ ফুট ৯ ইঞ্চি) এবং ত্রিতল দৈর্ঘ্যে ৭.৪৬মিটার (২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি) এবং প্রস্থে ৭.১৬ মিটার (২৩ফুট ৬ ইঞ্চি)। ফলে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখি এই মন্দিরের নিচের তলার ভিতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মিটার (২০ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ১.৩২ মিটার (৪ ফুট ৫ ইঞ্চি) চওড়া একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পিছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখি কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মিটার (৭ফুট ৬ ইঞ্চি) এবং ১.৯৮মিটার (৬ ফুট ৬ ইঞ্চি)। ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়া মাটির ফলক রয়েছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সে.মি. (১ ফুট৬ ইঞ্চি) উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদ প্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখি গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ম রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’ নামেও পরিচিত। নবরত্ন বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখি মন্দির আছে। এটি ‘দূর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত।

satkhira sonabari moth শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখি মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেমি (৩ ফুট) উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটি ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। মন্দিরটিরগুলোর সবকটি ইমারতে দৈর্ঘ্যে ২২.৮৫ সেমি. প্রস্থে ২০.৩১ সেমি. এবং উচ্চতায় ২.৫৩ সেমি. (৯ ইঞ্চি, ৮ ইঞ্চি, ১ ইঞ্চি.) পরিমাপের ইট ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। বর্তমানে এ মন্দির গুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮টি (মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল। অনেকের মতে, রামহংস পরমানন্দও এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন।

জানা যায়, মঠ মন্দির গুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয় পুকুরটি একই সময় কালের নিদর্শন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটিও সংরক্ষণ দরকার।

এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক মো. আমিরুজ্জামানযোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “শুধু সোনাবাড়িয়া মঠ নয়; সাতক্ষীরা জেলার মোট ১৪টি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা আঞ্চলিক অফিস একটি টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে হাল নাগাদ জরিপ কাজ শেষ করেছে। এ সংক্রান্ত চুড়ান্ত প্রতিবেদন পেলেই সংস্কার কাজে হাত দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এলাকাবাসীরা জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দির গুচ্ছের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিক- এটাই তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো খুলনা জাদুঘরের টিম পরিদর্শনের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এ মঠ মন্দিরটি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারতো সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সকল মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

happy wheels 2

Comments