আবুল কালাম মিয়া’র স্বপ্নের বাড়ির
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
ভাটি বাংলার একটি জেলা নেত্রকোনা। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে তৈরি করে দিয়েছে কৃষিবান্ধব এক অপরূপ পরিবেশ। তাই প্রকৃতিগতভাবেই কৃষির জন্য সমৃদ্ধ এই নেত্রকোনা অঞ্চল। প্রকৃতির অকৃপণ কৃপায় ছোট এই জেলাতে দেখা যায় বৈচিত্র্যময় ফসল ও প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার।
ষাটের দশকের পর সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগ ও উন্নয়নের নামে প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী পদক্ষেপের ফলে স্থানীয় ধান, সবজি, মাছ, নাম না জানা অসংখ্য প্রাণ আজ বিপন্ন প্রায়। উন্নত ও আধুনিক কৃষির নামে কৃষকদের আপন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় গড়া স্বনির্ভর, পরিববেশবান্ধব, কৃষক নিয়ন্ত্রিত কৃষিকে করে তোলা হয়েছে সার, বিষনির্ভর পরনির্ভরশীল বাণিজ্যিক একক ফসলের কৃষিতে। যেখানে কৃষকের দীর্ঘদিনের জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে করে তোলা হয়েছে মূল্যহীন। প্রকৃতিকে করা হয়েছে বিপন্ন।
এত বিপন্নতা আর বিনাশকালেও এখনো নেত্রকোনা অঞ্চলের কৃষকেরা বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করেন, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাসহ প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের জন্য করে চলেছেন নিরন্তর প্রচেষ্টা।
কৃষিকে কৃষকের নিয়ন্ত্রণে আনতে ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বালি গ্রামের কৃষক আবুল কালাম বিগত চার বছর ধরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরলসভাবে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছেন। আবুল কালাম নিজ উদ্যোগে ঘরেই গড়ে তুলেছেন একটি বীজঘর। আর এ বীজঘরের তদারকি করেন তার স্ত্রী জাহানার আক্তার। মাটির পাত্রে ও বোতলে স্থানীয় জাতের ধান, মসুর ডাল, মাসকলাই, তিল, সীম, শীতলাউ, মিষ্টিলাউ, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, শশা, পেঁপে, পুইশাক, আলু, মিষ্টি আলু, জাম আলু, ডাটা, লালশাক, ধুন্দল, বেগুন, চালকুমড়া, মরিচ, বরবটি, ঢেড়সসহ নানা জাতের ফসলের বীজ সংরক্ষণ করছেন।
এসব জাতের ফসল তিনি নিজের জমিতে চাষ করেন এবং সেখান থেকে বীজ রাখেন। বীজঘর থেকে তিনি গ্রামের অন্য কৃষকদেরকে বীজ দিয়ে থাকেন এবং বীজগ্রহীতা কৃষকদেরকে বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ দেন। বাড়ির আঙ্গিনায় ২০ শতাংশ জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় সবজির সমাহার। সে জমিতে বছরব্যাপী তিনি ডাটা, লালশাক, ধুন্দল, বেগুন, চালকুমড়া, মরিচ, সীম, শীতলাউ, মিষ্টিলাউ, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, শশা, পেঁপে, পুইশাক, গোল আলু ও মিষ্টি আলু চাষ করেন।
বাড়ির পাশে পুকুরে তিনি স্থানীয় জাতের মাছ চাষ করেন। পুকুরের চারপাশে মাঁচা তৈরি করে সারাবছর সেখানে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। উঠানঘেঁষে ঘরের পাশে চাষ করেছেন বারোমাসি বেগুন ও মরিচ। উঠানে পাখির কুপে রয়েছে স্থানীয় জাতের ২০টি মোরগ-মুরগি, ৩০টি হাঁস, দুই জোড়া কবুতুর এবং গোয়ালে রয়েছে ২টি গাভী ও চারটি ছাগল। হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গাভী পালন করেন স্ত্রী জাহানারা আক্তার।
কৃষক আবুল কালাম গত আমন মৌসুমে ৫টি স্থানীয় জাতের ধান (রতিশাইল, কালোজিরা, লোহাজাং, আইজং ও ব্রি-৩২) চাষ করেছিলেন। চাষকৃত পাঁচ জাতের ধানের বীজ তিনি সংরক্ষণ করেছেন। সাত জন জন কৃষক গত আমন মৌসুমে তার কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেছেন। বাড়ির পাশে পাঁকা হাউজে কেচোঁ কম্পোস্ট উৎপাদন করে জৈব উপায়ে এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ করছেন। তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষকদেরকে কৃষি বিষয়ে বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। কৃষক আবুল কালমের জৈব উপায়ে চাষাবাদের সফলতা দেখে গ্রামের অন্য ৪ জন কৃষক পরিবেশ বান্ধব উপায়ে সবজি চাষ করছেন। সবজি চাষে কোন ধরণের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ ব্যবহার না করে তিনি ফসল চাষে খরচের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তার পরিবেশবান্ধব কৃষি ফসল উৎপাদন গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের জন্য শিক্ষণীয়।
কৃষক আবুল কালাম জৈব ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল চাষ করে এবং স্থানীয় জাতের গবাদী পশু-পাখি ও মাছ চাষ করে শুধু উৎপাদন খরচই কমিয়ে আনেননি, পাশপাশি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে ভোক্তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় অনন্য ভূমিকা রেখে আসছেন। কৃষক আবুল কালামের মত সকল কৃষক যদি বিষমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে তাহলে সকল ভোক্তার নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান হবে। মানুষ মুক্তি পাবে নানা রকমের জটিল ও কঠিন রোগ থেকে। আসুন আমরা সকলে কৃষক আবুল কালামের ন্যায় পরিবেশবান্ধব ও জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য ফলাই এবং প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশকে নিরাপদ রাখায় অবদান রাখি।
অনুলিখন- শংকর ম্রং