জাতিগত বৈষম্য মোকাবেলায় সহনশীল এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই
সৈয়দ আলী বিশ্বাস
২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস (International day for the elimination of racial discrimination)। প্রতিবছরের মত এই বছরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। এই বছর বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: Promoting tolerance, inclusion, unity and respect for diversity in the context of combating racial discrimination যার বাংলা অনেকটা এই রকম “জাতিগত বৈষম্য মোকাবেলায় সহনশীলতা, আন্তর্ভূক্তি, ঐক্য এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো”। এই দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভ্যালিতে সাধারণ জনগণ জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিল পাশের বিরুদ্ধে ১৯৬০ সালে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে এবং পুলিশ বিনা উস্কানিতে মিছিলে গুলি করে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে সকল দেশের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য সকল দেশের প্রতি জোরালোভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পবিষদ জাতিগত বৈষম্য কমানোর জন্য সংহতি সপ্তাহ ঘোষণাসহ প্রতিবছর ২১ মার্চকে আন্তর্জার্তিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে ২১ মার্চ সারা বিশ^ একযোগে এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিবস পালনের সময়কাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য আইন বিলোপ ঘোষণা করা হয় যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বর্ণবাদ আইন এবং চর্চা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সকল প্রকার ধর্ম চর্চা, ব্যক্তি বিশেষের মননে ও চিন্তায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বর্ণবাদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় এখনও মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়নি।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়া মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের বসবাস। দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের সক্রিয় অবদান রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্র, পেশা নির্বিশেষে একে অন্যের সাথে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে এদেশের মানুষ। গড়ে তুলেছে জীবনবান্ধব আন্তঃনির্ভরশীল এক সম্পর্ক। কিন্তু সকল ধর্ম, বর্ণ, পেশা ও গোত্রের মানুষ সহবস্থানে থাকলেও জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার ভিন্নতাকে সমভাবে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে সকল সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বারসিক এই আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করে। বৈচিত্র্য সুরক্ষার ভেতর দিয়ে বহুত্ববাদী সমাজের স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলসুরও এই বৈচিত্র্য। তাই সমাজের বিদ্যমান সকল ধরণের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে মূলধারায় যুক্ত করা জরুরি। বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কেননা সামাজিকভাবে সৃষ্ট বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণে ইতিবাচক কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসকে পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত বৈষম্য, যুদ্ধ-দাঙ্গা-সন্ত্রাসের ফলে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী, পেশাগত ভিন্নতার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংকটাপন্ন জনগোষ্ঠী, ভিন্ন বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, রীতিনীতি পালনের ফলে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী, ভৌগলিক বাসস্থানের ফলে সৃষ্ট সংকটাপন্ন জনগোষ্ঠী ইত্যাদি নানাবিধ বৈষম্যের ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৈষম্যকে দূরীকরণের ভেতর দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কেননা এখানে সম্পর্কটা বহুমাত্রিক। প্রকৃতি ও সমাজে একে অপরের উপর, একে অপরের সাথে বা একে বহুজনের সাথে বা বহুজন একজনের সাথে বা বহুজন বহুজনের সাথে নানামূখী নির্ভরশীল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে টিকে থাকে। এই সম্পর্ককে যত বেশি আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারবো ততবেশি আমাদের দাম্ভিকতা এবং অহংবোধ কমে যাবে। মানুষের অহংবোধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমে আসবে। নিজের অস্তিত্ব কতভাবে কত কিছুর সাথে জড়িত তা বুঝতে পারলে উন্নয়ন সমানতালে ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা প্রভৃতির পারস্পারিক মঙ্গলজনক সহবস্থান জরুরি।
দেশের হিজরা, যৌনকর্মী, দলিত এবং হরিজনসহ অনগ্রসর নাগরিকদের প্রতি সকল ধরণের বৈষম্য বিলোপের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় “বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪” খসড়া তৈরি করেছে যা এখনও চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবেন। খসড়া আইনে বলা আছে; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানুষিক ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধিতা এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠির লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দিতে পারবেন আদালত। পরে প্রতিবারের জন্য ৫ বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা; কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসানালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এই দেশে থাকার কারণে এখানে পেশাভিত্ত্কি সংস্কৃতির ভিন্নতা বিদ্যমান। আমরা প্রায়শ বলি বৈচিত্র্যই সুন্দর, বৈচিত্র্যই সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য্য, বৈচিত্র্যই অগ্রগতি। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র পেশাগত ও গোত্রগত ভিন্নতার কারণে এই বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। একটি দেশের উন্নতি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি সবকিছুই বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে। প্রতিটি সমাজের প্রতিটি মাুনষই যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ পেশাভিত্তিক দক্ষতা। ভিন্ন পেশার অবদানকে মেনে নিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে, প্রকৃতিনির্ভর ভিন্ন পেশা শুধুমাত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু চাহিদায় পূরণ করেনা ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান চর্চা ও চিন্তা দর্শনকে বিকশিত করে। আমাদের সমাজে যেমন রয়েছে তাঁতি, মুচি, নরসুন্দর, কর্মকার, দলিত জনগোষ্ঠী তেমনি রয়েছে কৃষক, জেলে, কুমার, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, গাছি, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বনজীবী, কবি, শিল্পী। টিকে থাকার জন্য প্রতিটি পেশাই সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের পেশাকে সম্মান দেখানোর মাধ্যমেই আমরা নিজের পেশাকে সম্মানিত করে তুলতে পারি। বৈচিত্র্যময় পেশার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আমাদের আন্তঃনির্ভরশীল সমাজ। আমাদের এই আন্তঃনির্ভরশীলতা ও আন্তঃযোগাযোগর এই জাল বা পাটাতন যদি আমরা বৃঝতে পারি তবেই আমরা একটি বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। কারণ বহুত্ববাদী সমাজই শিখিয়ে দিতে পারে সকল প্রাণের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা ও দায়িত্ববোধ। এই দায়িত্ববোধ আসে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ চর্চার ভেতর দিয়ে। যখন কোন গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র দল নিজেদের বিশ্বাস-মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক চর্চা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে এবং বৃহত্তর সমাজের আইন ও নীতি তাদের বাধাগ্রস্ত করে না এবং তারাও সর্বোপরি বৃহত্তর সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশে অবদান রাখে সেই চিন্তা দর্শন চর্চাই সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের দেশ। এই দেশ প্রাকৃতিক উপাদানের ভিন্নতাকে বিবেচনা করে নানা সংস্কৃতি এবং ভিন্ন বর্গ ও গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বকীয় চর্চাগুলো গড়ে তুলেছে। দরকার এটিকে চর্চার ভেতর দিয়ে বিকশিত করার। আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য দিবসে আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক দেশের সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অবদান রাখার। যেখানে দেশের সকল মানুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে।