কালিনগর অবিরাম গ্রাম উন্নয়ন সংগঠনের পথচলা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রাম কালিনগর। অতীতে এটি কৃষিনির্ভর একটি গ্রাম ছিল। ১৯৮০ সালের দিকে উপকূলীয় স্লুইচ গেটের মাধ্যমে লবণ পানি উঠিয়ে উক্ত গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি চিংড়ি চাষ শুরু করেন। আর সেখান থেকে চিংড়ি ঘেরের প্রভাব বিস্তার ঘটে। তারপরও স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের অভিযোজন উদ্যোগে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করছেন। পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পূরুণে যার যতটুকু জায়গা আছে সেখানে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করতেন। বিগত সময়ে অর্থাৎ ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক দূর্যোগ শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মত এ ইউনিয়নটির কালিনগর গ্রামটি মারাত্মক ক্ষতির সন্মূখীন হয়। এমনকি গ্রামটি নদীকুলবর্তী হওয়াতে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দূর্যোগ সন্মূখীন হতে হয়।
২০১৩ সালের জুন মাসের দিকে বারসিক কর্মকর্তারা মাঠ পর্যবেক্ষণে কালিনগর গ্রামের কয়েকজন যুবকের সাথে আলোচনা করেন। আলোচনায় যুবকরা তাঁদের এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা নদী ভাঙনের কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, নদী ভাঙনের কারণে তাদের উপকূলীয় বা নদীকুলবর্তী মানুষের জীবন জীবিকা হুমকির মুখে। আর এ থেকে উত্তরণের জন্য যুবরা নদীর চর বনায়ন করা কথা জানান এবং বারসিককে সহায়তা করার আহবান জানান। সে অনুযায়ী স্থানীয় জনগোষ্টীর উদ্যোগে কালিনগর গ্রামে প্রায় এক কিলোমিটার বনায়ন করা হয় এবং তারা একটি বনায়ন কমিটি গঠন করেন। পরবর্তীতে বনায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং উপকূলীয় এলাকার জন্য লবণ সহনশীল নার্সারি তৈরি করেন। যা নদীর চরে বনায়ন কাজে লাগবে এবং এ চারা স্বল্পমূল্যে বিভিন্ন প্রতিষ্টান ও ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করবে। একই সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে জনগোষ্টীর মাঝে আগ্রহী তৈরি এবং স্বল্প সুদে তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ, এবং মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুযোগ সুবিধা আদায় করতে পারেন।
মানুষের উন্নয়নে যাতে একসাথে জন কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে একটি সংগঠন তৈরি উদ্যোগ গ্রহণ করেন এই যুবকরা। এই সংগঠনের নাম দেন ‘কালিনগর অবিরাম গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন’। সংগঠন তৈরির পর থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যেমন সঞ্চয় কার্যক্রম সম্প্রসারণ, বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, বিভিন্ন দিবস পালন, নদীর চর বনায়ন, বনজ নার্সারি তৈরি, বিভিন্ন দিবস ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আযোজন, রাস্তা সংস্কার, নারীদের সেলাই ও গবাদী পশু পালন, পরিবেশ বান্ধব চুলা তৈরি ও ব্যবহার প্রশিক্ষণ আয়োজন, মৌসুমভিত্তিক সবজি বীজ বিতরণ,বয়স্ক শিক্ষা চালু, রক্তের গ্রুপ নির্নয়, স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বর্তমানে এই সংগঠনের ৫৬ জন সদস্য রয়েছে। এছাড়াও সঞ্চয় কার্যক্রম মুন্সিগঞ্জ এবং ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ৮টি গ্রামে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সেখানেও ২২০ জন সদস্য রয়েছে। এই প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি বিভাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, “আমরা এ সংগঠন করেছি আমাদের এলাকার মানুষের জন্য। যেখানে বাইরের কোন এনজিও কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে বেশি সুদ দিতে হতো সেক্ষেত্রে আমরা জমাকৃত টাকার উপর ৬% সুদে ঋণ বিতরণ করছি। এবং বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। একই সাথে নিজেদেও সমস্যা সমাধানসহ একত্রিত হয়ে গ্রাম ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবো।” সদস্য চন্দনা রানী বলেন, “আমাদের এ সংগঠন হয়ে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারছি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারছি। আমি পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করতে পারি এবং দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজে বাড়িতে দর্জি কাজ করছি। এখান থেকে আমার মাসে প্রায় ১৫০০ টাকার মতো আয় হয়।”
সংগঠনের সদস্যরা সম্প্রতি সংগঠনের নিজস্ব ঘর তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে লক্ষ্যে সংগঠনের মাসিক আলোচনা সভার মাধ্যমে সংগঠনের ঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সংগঠনের সভাপতি বিভাস চন্দ্র মন্ডল তার ১.৫ শতক জায়গা দেন এবং সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সংগঠনের ঘর তৈরির চেষ্টা করছেন। এরপর নিজেদের কার্যক্রম গতিশীল করতে সংগঠনের সদস্যরা সংগঠনের নিবন্ধন পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বারসিকের সাথে যোগাযোগ করেন। বারসিকের সহযোগিতায় সংগঠনটি উপজেলা সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধন প্রাপ্তিতে আবেদন ও যোগাযোগ করেন। যোগাযোগের এক পর্যায়ে এসে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সংগঠনটি শ্যামনগর উপজেলা সমবায় অধিদপ্তরের নিকট থেকে নিবন্ধন লাভ করে যার নং ০৬৫ সাতক্ষীরা। যা তাদের কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও সংগঠন শক্তিশালীকরনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার প্রত্যন্ত কালিনগর এলাকার একদল সমমনা আগ্রহী জনগোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগ ও সুচিন্তিত মতামত এবং সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গড়ে ওঠা অবিরাম গ্রাম উন্নয়ন সংগঠনের পথচলা এভাবেই শুরু হলো।