পদ্ম ফুল ভূমিকা রাখছে নাজিম উদ্দিনের জীবন-জীবিকায়

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

জীবন-জীবিকা নির্বাহে মানুষ বিচিত্র পেশার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত এমন অনেক মানুষ আছেন যারা পুজির অভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেন না ব্যবসা বাণিজ্যে। নিজের শ্রমকে পুজি করে অর্থ উপার্জন করেই সংসার পরিচালনা করতে হয় তাদের। এজন্য তাদের সংগ্রামও করতে হয় নিরন্তর। এরকমই একজন সংগ্রামী মানুষ পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ধরইল মৎসজীবী পাড়ার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন (৬০)। গত ৫ বছর যাবত চাটমোহর ও এর পাশর্^বর্তী বিলসমূহ থেকে পানিতে ভাসমান জলজ উদ্ভিদ এর মনোলোভা পদ্ম ফুল তুলে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। মানুষের উদ্ভিদ নির্ভরতার এটিও একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

podmo-4

নাজিম উদ্দিন বলেন, “প্রতিটি মানুষ যার যার অবস্থান থেকে স্বচ্ছলভাবে চলার স্বপ্ন দ্যাখে। চলার চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকে অভাবের মধ্যে বড় হই। পড়ালেখা করতে পারিনি। স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়ে আর আমি এ পাঁচজনের সংসার পরিচালনা করতাম। বড় ছেলে আজদুল পড়ালেখা করেনি। কর্মক্ষম হবার পর বিয়ে দিলে স্বস্ত্রীক পৃথক সংসার পাতে। মাছ ধরার খলসুনী বানিয়ে হাটে হাটে বিক্রি করে। মেজ মেয়ে রাহিলাকে অনেক কষ্টে ৪০ হাজার টাকা যৌতুকে ডাহিয়া গ্রামে বিয়ে দেই। এখন ছোট ছেলে সাইদুল, তার স্ত্রী ও আমরা স্বামী স্ত্রী এ চারজনের সংসার পরিচালনা করতে হয় আমাকে।”

তিনি আরও বলেন, “সাইদুল খলসুনী বানিয়ে বিক্রি করে আমাকে কিছু সহায়তা করে। কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী খাজুরবি খাতুনের পায়ে সেপটিক ঘা হয়। অনেক টাকা পয়সা খরচ করে চিকিৎসা করাই। কিন্তু তা কোন কাজে আসে না। অবশেষে বছর তিনেক আগে তার পা কেটে ফেলতে বাধ্য হই। আমি ভূমিহীন ছিলাম। চাটমোহরের বিল কুরুলিয়ার খাস জমি বন্দোবস্তের সময় ১০ কাঠা খাস জমি বন্দোবস্ত পেয়েছি। ধান হলে এতে কয়েক মাসের পেটের ভাত হয়। দৈনিক অন্তত তিনশ’ টাকা সংসার খরচ। এছাড়া কাপড় চোপর রোগ ব্যাধিসহ অন্যান্য প্রয়োজন ও মেটাতে হয়। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো কাজ করার সক্ষমতাও নেই। তাছাড়া পরের বাড়ি কাজ করতে ভালোও লাগে না। তাই বছরের ৬ মাস বৈশাখ থেকে অশি^ন বিলকুরুলিয়া, সাতৈল বিল, গল্যার বিলসহ বিভিন্ন জলাশয় থেকে লাল পদ্ম ফুল তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছি।”

podmo-1

তিনি বলেন, “খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নৌকা নিয়ে বিলে চলে যাই। সকাল সকাল ফুল তুলে পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও নাটোরের গুরুদাসপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করি। একেক দিন একেক এলাকায় যাই। স্কুল কলেজের গেটসহ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফুল বিক্রি করি। ৪ থেকে ৫ টাকা জোড়া ফুল বিক্রি করি। বিকেল নাগাদ রাস্তার অলি গলিতে কয়েক কিলোমিটার হেটে ফুল বিক্রি করি। কখনো কখনো কিছু ফুল অবিক্রিত থেকে যায়। কাছা কাছি কোথাও মেলা খেলা বা অন্য কোন অনুষ্ঠানাদি হলে সেখানে চলে যাই ফুল বিক্রি করতে। এভাবেই পদ্ম ফুল বিক্রি করে কোনমতে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি।”

podmo-2

কেবল নাজিম উদ্দিন নয় এমন আরো অনেক অভাবী মানুষ বিল ঝিল হাওর বাওর থেকে পদ্ম ফুল তুলে বিক্রি করে সংসার পরিচালনা করছেন। যেসব বিল খালে সারাবছর পানি জমে থাকে এমন জায়গাগুলোতে এ উদ্ভিদ জন্মে। বর্ষা ও শরৎকালে এ ফুল বেশি ফুটে থাকে। পদ্মের লাল গোলাপী ও সাদা রঙের সুগন্ধি ফুল মানুষকে আকৃষ্ট করে। এর মূল কান্ড ও ফুলের বীজ খাওয়া যায়। শুভ্রতার প্রতীক বলে পুজো পার্বণেও ফুলের রানী পদ্মের ব্যবহার পরিণক্ষিত হয়। কবি সাহিত্যিকেরা সাহিত্যের পরতে পরতে লিখে রেখেছেন পদ্ম ফুলের কথা। প্রকৃতি প্রেমীরা সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যান পদ্মসমৃদ্ধ বিল খাল জলাশয়ের পাশে।

happy wheels 2

Comments