আত্মপ্রত্যয়ী সুমিত্রা রানী

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম কাচড়াহাটি। গ্রামটি মুলত একটি কৃষি সমৃদ্ধ গ্রাম। কৃষির সব রকম নিদর্শন আছে গ্রামটিতে। এ গ্রামে বসবাস করেন সুমিত্রা রানী। সুমিত্রা রানীর স্বামী রমেশ মন্ডল একজন দিনমজুর। সংসারে স্বামী ও দুই পুত্র সন্তানসহ চারজনের সংসার। সুমিত্রা রানীর জমি জমা বলতে দু’বিঘা জমি, যা বিলেন জমির সাথে যুক্ত। বসতভিটায় সবজি চাষ করার জন্য প্রায় ৮ কাঠা। বাকিটায় বসতঘর, পুকুর ও ধান চাষ করেন। সাথে আরো ২ বিঘা জমি হারি (লিজ) নিয়ে ধান চাষ করেন। বছরব্যাপি ভিটায় ও বিলেন জমিতে নানান ধরনরে সবজি, মসলা, ডাল, সরিষা, ধান ও মাছ চাষ করেন। সাথে গবাদিপশুও পালন করেন।


সুমত্রিা রানীর খুবই অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সংসারের অবস্থা খুবই ভালো ছিলো। স্বামীরা তিন ভাই সবাই একসাথে থাকতেন। প্রায় ১০ বিঘার মতো জমি ছিলো। সাথে স্বামীদের শ্যামনগরে নামকরা ব্যাটারির দোকান ছিলো। খুবই আরাম আয়েশে তাদের দিন চলতে থাকে। সেখান থেকে বছর সাতেক যাওয়ার পর ভাইয়েরা আলাদা হয়ে যান। ব্যবসা তখন অন্য দু’ভাই নিয়ে নেন। শ্বশুর জমি জমা সবার সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চাইলে অন্য ভাইয়েরা বাধ সাজে। এতে করে বড় ও ছোট ভাই ৮ বিঘা জমি নিয়ে নেয় এবং বাকী ২ বিঘা সুমিত্রা রানীদের ভাগে পড়ে। দু’বিঘা জমিতে তো আর সংসার ভালোভাবে চালানো যাবে না। ধান চাষের পাশাপাশি যোন দেওয়া, ভিটার উপর নানান ধরনের সবজি চাষ, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান, ডাল, সরিষা চাষ করেন। স্বামী রমেশ মন্ডল মাঝে মাঝে ইটের ভাটায় যায় কাজের জন্য। এদিকে বাড়ির সবকিছু দেখাশুনা ও চাষের ক্ষেত বাড়ানো সব কাজই করতে হয় সুমিত্রা রানীকে।


সুমিত্রা রানী বলেন, ‘এভাবে কোন রকমে চলতে ছিলো। চলতে চলতে একদিন আবার আমাদের বিপদ নেমে এলো। বজ্রপাতে বড় ছেলেটির একপাশ পড়ে যায় এবং কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন একেবারে ভেঙে পড়ি। একদিকে ছেলের এ অবস্থা অন্যদিকে সংসারের অবস্থা। সব কিছু মিলে যেন হতাশাময় জীবন। তখন নিজের মনকে সান্ত¡না দিই এবং স্বামী স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করতে থাকি। ছেলের চিকিৎসা এবং সংসারের অবস্থা উন্নতির জন্য আরো বেশি করে খাটতে শুরু করি। আস্তে আস্তে লিজ নেওয়া জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকি। বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, পুকুরে নানান ধরনের মাছ চাষ করতে থাকি। এভাবে আস্তে আস্তে ছেলেও ভালো হতে থাকে এবং নিজের সংসারের অবস্থাও পরিবর্তন হতে থাকে।’


সুমিত্রা রানী আরো বলেন, ‘এখন সারাবছর ধান, সবজি, মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু- ছাগল পালন করছি। এখন আমার ভিটায় সারাবছর কোন না কোন সবজি থাকে। আমন ধান উঠে গেলে জমিতে খেসারির ডাল ও সরিষা লাগাই। আবার গরমের সময় চৈতি মুগ ডালও লাগাই। এখন আমার গরু আছে ৪টি, হাঁস আছে ২২টি, মুরগি আছে ১৩টি, ছাগল আছে ৩টি। পুকুরের মধ্যে যেমন বিভিন্ন মাছ চাষ, তেমনি পুকুর পাড়ে সবজি, পুকুরের তিন পাশে বিভিন্ন জাতের কচু ল্গাাই।’


সুমিত্র রানী বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে এখন আমরা আগের থেকে একটু সুস্থ আছি। বাড়ির সবজি এখন যেমন নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে বিক্রি করছি তেমনি পাড়া-প্রতিবেশীদের বিভিন্ন সময় সহায়তা করছি। এছাড়াও ১০ কাঠা জমি বন্ধক রেখেছি ৫০,০০০ হাজার টাকার বিনিময়ে। যে কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে একটা ভালো অবস্থার দিকে যাচ্ছি। ছেলেরা এখন লেখাপড়া করছে। ওরা মানুষ হলে হয়তোবা আরো ভালো থাকবো। এতো কষ্ট সব কিছূ তো ওদের জন্যা। নিজের উপর পুরো বিশ্বাস ছিলো যে একটা ভালো অবস্থায় যেতে পারবো। সেই বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস আমাকে আজ এতো দূরে এনে দিয়েছে। এখন যেকোন এনজিও আসলে আমাকে খোঁজ করে। আমার এ কাজের জন্য বারসিক যে শতবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে আমার বাড়িটা নির্বাচত হয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রেখেছে। গ্রামের অনেককে এখন বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করতে পারি। গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সরকারী বেসরকারী সেবা পেতেও সহায়তা করি।’


শুধু মাত্র মনের বল ও আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোন কঠিন সমস্যার মধ্যে থেকে বের হওয়া যায়। তার এক দৃষ্টান্ত সুমত্রিা রানী। সুমিত্রা রানীর মতো এরকম অনেক নারী তাদের আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে সাফল্যের দ্বারে পৌছানোর চেষ্টা করছেন। তাদের কাজের সঠিক সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে তাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুয়োগ তৈরি করা দরকার।

happy wheels 2

Comments