চলনবিল এলাকার শুটকি মাছ শিল্পে অনিশ্চয়তা
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
কয়েক বছর আগে ও আ কার্তিক মাসে চলনবিল এলাকার বাতাসে ভাসতো শুটকি মাছের গন্ধ। এ সময় মাছ শুকানোর কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন শুটকি শিল্পের সাথে জড়িত শত শত নারী ও পুরুষ শ্রমিক। কালের বিবর্তনে মাছের যোগান কমে আসায় এ শিল্পে ভাটা পরতে থাকে। চলতি মৌসুমে এ শিল্পের পরিধি একেবারেই কমে এসেছে। কাঁচা মাছ সংকটের কারণে অনেক শুটকি ব্যবসায়ী চলতি মৌসুমে এ ব্যবসা শুরুই করতে পারেননি। হাতে গোনা কয়েকটি চাতালে চলছে মাছ শুকানোর কাজ।
এ বছর আশি^নের শেষ দিকে এসে চলনবিলের নদী খাল বিলের পানি দ্রুত কমে যায়। অন্যান্য বছর এসময় প্রচুর মাছ ধরা পরলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম। যে যৎসামান্য মাছ ধরা পরছে তা এ এলাকার জেলেরা অধিক দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। চলনবিল এলাকার অন্যতম মাছের আড়ত মহিষলুটিসহ অন্যান্য আড়ত হাট বাজার থেকে কাঁচা মাছ কিনে ব্যবসায়ীরা তা সরবরাহ করছেন ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায়।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, এককালে চলনবিল রাজশাহী জেলার নাটোর মুহকুমার তিন চতুর্থাংশ, নওগা মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা এবং পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা ও সদরের চাটমোহর ফরিদপুর ও বেড়া এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। বগুড়া জেলার দক্ষিনাঞ্চলের কিছু অঞ্চলও চলনবিলের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯১৪ সালে সাড়া-সিরাজগঞ্জ রেল লাইন স্থাপিত হবার পর চলনবিল দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরে। এখন এ রেল লাইনের উত্তর পশ্চিমাংশকেই চলনবিল বলা হয়।
চলনবিল এলাকার উল্লেখযোগ্য বিল গুলো হলো, বড় বিল, খলিশাগাড়ি বিল, ধলাইর বিল, ছয় আনি বিল, বাইরার বিল, সাধুগাড়ি বিল, মহিষা হালট, চাকল বিল, বৃগড়িলা বিল, কুমিরাগাড়ি, কৈগাড়ি, নিহালগাড়ি, চেচুয়া, টেংড়াগাড়ি, চাতরাবিল, খোলার বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, ধলার বিল, বালোয়া, আমদাকুড়ি, বাঙ্গাজালী, হুলহুলিয়া, কালামকুরী, রঘুকদমা, বোয়ালিয়া, হরিবিল, হরিবিল, বুড়ি বিল, রহুয়া, সোনাইডাঙ্গা, নলুয়াকান্দি, বেরল, কচিয়া, কাশিয়ার বিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, বিলকুরুলিয়া, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুথনাডাঙ্গা, রউল, সাঁতৈল, পাতিয়া বিল, আইড়মারী, কৈখোলা, গলিয়া, চিনাডাঙ্গা, মেরীগাছা ও খলিশাডাঙ্গা। খাল গুলোর মধ্যে হক সাহেবের খাল, নবীর হাজীর জোলা, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল, নিমাইচড়া-বেশানী খাল, জহির সরকারের খাল, দোবিলা খাল, কিশোর খালি খাল, বেহুলার খাড়ি, গাড়াবাড়ি-ছারুখালী খাল, জনিগাছার জোলা উল্লেখযোগ্য। নদীগুলোর মধ্যে আত্রাই, মরা আত্রাই, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলশী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গুমানী উল্লেখযোগ্য।
এসব নদ নদী খাল বিলে একসময় প্রচুর পরিমাণে কৈ, মাগুর, বাঁচা, রুই, কাতল, বাটকে, মৃগেল, বাউশ, আইড়, রিটা, বাঘাইর, শিলং, চিতল, ফলি, বোয়াল, পাবদা, টেংড়া, গলশা, বাইম, গুচি, শৈল, গজার, টাকি, নদই, শিং, খলিশা, পুটি, চিংড়ি, কাকলা, কালবাউশ, ফাতাশী, বাশপাতা, মৌসি, রায়াক, শিলং, চ্যাং, চাঁদা, চেলা, চাপিলা, গাগর, ভূল, গুজ্যা, বৌমাছ পাওয়া যেত। জেলেরা খড়া, জগতবের, বাদাই, চাপরা, হাতপাচি, সাংল্যা, দোড়া, খলশুনি, খেয়াজাল, পলো, বড়শি, ঠুশি, সাটিজালসহ বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরার উপকরণের সাহায্যে মাছ ধরতো। তখন অভাব কি জিনিষ বুঝতেন না জেলেরা। বর্ষাকালে মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিতেন তারা। উদ্বৃত্ত মাছ শুটকি করতো। উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুর, নিলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠানো হতো শুটকি মাছ। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে চলনবিলের বাতাসে ভাসতো শুটকি মাছের গন্ধ। কালের বিবর্তনে এসব মাছের অনেক প্রজাতিই এখন বিলুপ্তির পথে।
নাটোরের বনপাড়া-সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল সড়কের মহিষলুটি এলাকায় রাস্তার পাশের শুটকি চাতালে অস্থায়ী তাবু জাতীয় ঘরে সম্প্রতি কথা হয় নারী শুটকি শ্রমিক আসমা ও মাজেদা খাতুনের সাথে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার ললিয়াকান্দি গ্রামের মৃত জোনাব আলীর স্ত্রী আসমা খাতুন বাড়তি কিছু আয় করার জন্য শুটকির মৌসুমে শুটকি চাতালে কাজ করেন। তিনি বলেন, “গত কয়েক বছর যাবত শুটকি মৌসুমে শুটকির চাতালে কাজ করি কিন্তু মাছের এমন আকাল আগে কখনো দেখিনি। শুটকি চাতালে কর্মরত একই গ্রামের হানেফ আলীর স্ত্রী মাজেদা খাতুন (৫০) বলেন, ‘আমার স্বামী মান্নান নগরের পাশর্^বর্তী মহাশৈল গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছেন দীর্ঘ দিন যাবত। আমার ভরণ পোষণ দেন না। আমাকে নিজে উপার্জন করে খেতে পরতে হয়। যখন যে কাজ পাই সেটিই করি। প্রতিবছর শুটকি মৌসুমে শুটকির চাতালে কাজ করি। অন্যান্য বছর আমার মত শত শত মেয়ে শুটকির চাতালে কাজ করলেও চলতি মৌসুমে মাছ সংকটের কারণে অনেক নারী শ্রমিক বাড়িতে বসে সময় কাটাচ্ছেন।’
মহিষলুটি মাছের আড়তের পাশে শুটকীর চাতাল দিয়েছেন সলঙ্গার সেকেন্দাসপুর গ্রামের দেলবার হোসেন (৫০)। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর শুটকির মৌসুমে চাতাল পাতি। ভাদ্র থেকে মাঘ এ ছয় মাছ চাতালে মাছ শুকাই। অন্যান্য বছর কার্তিক মাসে সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পরতো। কিন্তু এ বছর চলনবিল এলাকায় বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ব্যবসায়ী এ পর্যন্ত ব্যবসা শুরুই করতে পারেননি। অন্যান্য বছর এসময়ে চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় তিন শতাধিক শুটকি মাছের চাতালে মাছ শুকানোর কাজ চলতো। হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতো। কিন্তু এ বছর হাতে গোনা কয়েকটি চাতালে চলছে মাছ শুকানোর কাজ। এসময় অন্য কাজ না থাকায় জেলেরাও বেকার সময় কাটাচ্ছেন। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি পুটি মাছ আকার ভেদে ৫০ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলেলই চলে।’
এ ব্যাপারে চাটমোহরে কর্মরত সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অন্যান্য বছর চলনবিলের পানি ধীর গতিতে নিষ্কাশিত হলেও এ বছর তা দ্রুত নিষ্কাষিত হওয়ায় এবং কয়েক দিনের মধ্যে বিল থেকে পানি নেমে যাওয়ায় অন্যান্য বছরের মতো মাছ ধরা পড়েনি। তাছাড়া আশি^নের শেষে বৈরী আবহাওয়ার কারণে পানি দ্রুত নামলেও মাছ ধরতে পারেনি জেলেরা। ফলে মাছ শুটকি করা ও সম্ভব হয়নি।’