আজকের যুগের রোকেয়া সীমা সরকার
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
১৮৮০ থেকে ২০১৮ সাল একশ’ ৩৮ বছরের ব্যবধান। সময়ের সাথে সাথে সমাজে নারীদের অবস্থানের উন্নয়নও হয়েছে অনেকটা। তৎকালীন বাঙালি সমাজে নারী শিক্ষার, সমাজে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রদূত হিসেবে সাহসী এবং আত্মপ্রত্যায়ী হিসাবে আমরা পেয়েছিলাম বেগম রোকেয়াকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে কুসংস্কারাছন্ন সমাজ এবং ব্রিটিশ বেড়িবাঁধা রাষ্ট্রে তিনি নারীদের জন্য শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ছিলেন।
১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁরই দেখানো পথ ধরে বাঙালি নারীরা আজ উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজে বেগম রোকয়ার অবদানের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর দিনটি রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের ‘অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন’ ৯ই ডিসেম্বর গ্রাম পর্যায়ে উদ্যাপন করেছে ‘রোকেয়া দিবস ২০১৮’।
অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের সদস্যরা দিবসটিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্রামের নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে (বিশেষভাবে নারী শিক্ষায়) সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন প্রেরণাদায়ী মায়েদের একজন (৮৩ তম) সীমা সরকারকে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসে। শারীরিক প্রতিবন্ধি সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্য সীমা রানীর সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনার জন্য ফচিকা গ্রামের দরিদ্র সংগ্রামী নারী আছিয়া আক্তারসহ গ্রামের অনেক নারী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়।
সীমা সরকার নেত্রকোনা পৌর শহরের কুড়পাড় এলাকার নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য। তার দুই ছেলে সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ছোট থেকেই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী, নাম হৃদয় সরকার। অদম্য ইচ্ছা শক্তি দৃঢ় মনোবল থাকলেই যে কোন অসাধ্যকে সাধন করা যায় তারই প্রমাণ সীমা সরকার। সীমা সরকারের স্বপ্ন ছিল জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধি সন্তান হৃদয় সরকারকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। স্বপ্ন বাস্তায়নে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধি সন্তানকে কোলে করে দৈনিক স্কুলে আনা-নেয়া করেছেন। ছেলে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে চলতি বছর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সীমা সরকার ছেলেকে ছেলেকে কোলে করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নিয়ে যান। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধি সন্তান হৃদয় সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সাথে সাথে সীমা সরকার স্বপ্ন পূরণে অর্ধেকটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
সীমা সরকারের ন্যায় কত অজানা জীবনের গল্পইনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে, তাদের কেউ খবর হয়, কেউবা আবার নিরবেই থেকে যায়। এসব নারীরা নীরবে জীবনের সফলতার গল্প তৈরি করে দেশের উন্নয়নের পাটাতনকে করে যাচ্ছেন মজবুত। তেমনি একটি গল্পের প্রধান নারী চরিত্র নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ফচিকা গ্রামের ষাটোর্ধ আছিয়া আক্তার। তিনি অতি দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে নিজ পাঁচ সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করেছেন। নিজে লেখাপড়া না জানলেও আজ তিনি সবার সামনে বলতে পারেন, রোকেয়া ছিল বলেই আজ দারিদ্রতার সাথে সন্তানদের শিক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে পেরেছি।
উল্লেখ্য যে, কিশোরী সংগঠনটি অন্যান্য জন সংগঠনগুলোর ন্যায় সমাজে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ নিয়ে নিজেরাই তা বাস্তবায়ন করে আসছে। রোকেয়া দিবস উপলক্ষ্যে অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগে সদস্যদের জমানো টাকা এবং বারসিক’র সহয়তা দুইজন শ্রেষ্ঠ মাকে শীতের চাদর দিয়ে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সংগঠনের এহেন উদ্যোগ গ্রামে তথা সমাজের লোকদের খুবই প্রশাংশিত হয়েছে।