কারও বোঝা হতে চাই না-মনি হালদার
মানিকগঞ্জ থেকে আছিয়া আক্তার
প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায়। করতে চায় তার মনমতো কাজ কিন্তু আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা সেই মনমতো কাজের জন্য অনুকূল নয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় এবং আত্মনির্ভরশীল জীবনই তাকে আত্মমর্যাদার সম্মান দেয়। সেই আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতার লড়াই করে টিকে আছে সমাজে অসংখ্য নারী-পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর মর্যাদা কাজের সমমজুরি ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হলেও কিছু মানুষ এখনো উদাহরণ হয়ে সমাজে আলোর পথ দেখাচ্ছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মানিকগঞ্জ জেলাধীন সিংগাইর উপজেলার বায়রা গ্রামের মাঝি পাড়ার মনি হালদার (৭০)। তৎকালীন সময়ে পারিবারিক সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার মতো সাহস ছিল না বিধায় মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মণি হালদার বাল্য বিবাহের শিকার হন।
১৯৬৬ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার পুরামন চরে তার বিয়ে হয়। স্বামীর নাম রাখাল হালদার মাছের ব্যবসা করতেন। আজ থেকে ৩ বছর আগে তিনি মারা যান। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে হয়। কিন্তু মেয়েটা ছোট বেলাতেই মারা যায়। বড় ছেলের নাম সকাল আর ছোট ছেলের নাম নিখিল। মা আদর করে ডাকেন সকাইল্যে আর নিখিইল্যে। দু’ভাই মিলেই মাছের ব্যবসা করেন। দুই ছেলেকেই বিয়ে দিয়েছে মনি হালদার। বড় ছেলের এক মেয়ে এক ছেলে, ছোট ছেলেরও এক ছেলে এক মেয়ে। নাতিনাতনিতে ভরা তার সংসার। এ বৃদ্ধ বয়সে নাতিনাতনি নিয়ে আনন্দে ঘরে বসে দিন কাটানোর কথা থাকলেও ছেলেদের কাছে বোঝা হতে চান না মনি হালদার।
তিনি গ্রামে গ্রামে, স্কুলে স্কুলে নিমকি, চানাচুর, সাফা, আচার বিক্রি করে আয় করেন। এ নিমকি, চানাচুর সাফা দিয়ে সান্তনা করে নাতি নাতনিকে আবার ছেলের বউদের মন রক্ষা করে মাঝে মাঝে নতুন শাড়ি কাপড় কিনে দেন। প্রতিদিন তিনি এগুলো বিক্রি করে আয় করতেন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। কিন্তু স্কুলে অন্যান্য বিক্রেতা যেমন বাদামওয়ালা ও ঝালমুড়িওয়ালার মাঝে অনেক ঝগড়া হলে স্কুলের শিক্ষকরা ঝালমুড়িওয়ালাও বাদামওয়ালার সাথে সাথে মনি হালদারকে ও স্কুলে বসতে দেন না। যার ফলে তিনি স্কুল থেকে অনেক দুরে একটা জায়গায় বসেন। এতে আগের তুলনায় বেচাকেনা অনেক কমে যায়। কেননা মনি হালদার যে পাশে বসে কম সংখ্যক শিক্ষার্থী সে পাশ দিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি নিমকি, চানাচুর, সাফা বিক্রি করে আয় করেন ৮০ থেকে ৯০ টাকা। এ ছোট ব্যবসায়ী মনি হালদারকেও আবার বাকিতে বেঁচতে হয় দিনে ২০/৩০ টাকার। ছোট ছোট বাচ্চারা যখন তার সামনে গিয়ে টাকা ছাড়া দাঁড়ায় আর খাবার চায় তখন তিনি আর ‘না’ করতে পারে না । বাচ্চাদের বাবা মায়ের কাছে টাকা চাইলে অনেক বাবা মা দেন আবার কোন কোন বাবা মা দেন না। তারপরও তা নিয়ে তাঁর কোন অভিযোগ নেই!
মনি হালদারদের বাঁচিয়ে রাখতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে তেমনি সমাজে নারীর কাজের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, আছিয়া ও ইস্মিতা আক্তার জামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সাথে মণি হালদার এর বিষয়ে কথা বলেন এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ইতিবাচক সারা দেয়। তাঁরা তাঁকে তার পছন্দমত জায়গায় নিমকি, চানাচুর বিক্রির অনুমতি দেন। মনি হালদারকে এ বিষয়ে অবগত করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আর সেখানে বসব না আমার আত্মমর্যাদা আছে। আমি করুণা নিয়ে বাঁচতে চাই না, আমি সরকারি জায়গায় ব্যবসা করি, বেচাকেনা কম হলেও এখানেই ভালো আছি। অনেকদিন হয়ে গেল এখানেই চলছে। সময়মত কাজটি হলে আমি আসতাম। তবুও আপনাদের প্রতি আমি অনেক খুশি যে আমার মত অবহেলিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।’