লবণাক্ততা: নারীর বিভিন্ন রোগের কারণ
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে চম্পা মল্লিক
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামে লবণাক্ততা ও নারীদের নানাবিধ সমস্যা বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা সভা আনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভাতে দাতিনাখালী গ্রামের ২৪ জন জনগোষ্ঠীসহ বারসিক কর্মকর্তা চম্পা মল্লিক উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় আলোচনা হয় এলাকার লবণাক্ততা ও নারীদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে।
সভায় নারীরা বলেন, ‘একেবারে নদীর পাড়েই আমাদের বসবাস হলেও একসময় এই এলাকায় ধান মাছ সবই হতো। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চিংড়ি চাষ ও বর্তমানে কাঁকড়া চাষ হতে হতে এই এলাকা সম্পূর্ণ লবণে পরিণত হয়ে গেছে! লবণাক্ততা আগের তুলনায় খুব বেড়েছে। কারণ আগে এসব চিংড়ি ঘেরে মিষ্টি পানির মাছও হতো এবং প্রায়ই বাড়িতে দেশীয় ফলের গাছ ছিল। কিন্তু এখন ঘেরে মিষ্টি পানির মাছের পোনা দিলে মরে যাচ্ছে। আর বাড়িতে কোন ফলের গাছ লাগানো যাচ্ছে না। যেগুলো ছিল তাও মরে যাচ্ছে।’
আলোচনায় শেফালী বিবি (৫৫) বলেন, ‘এই লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে নারীদের উপর। বেড়ে গেছে আগের তুলনায় নারীদের নানা ধরনের কঠিন রোগ ব্যাধি। যেসব রোগ বর্তমানে দেখা দিয়েছে তা হলো গায়ের রং কালো হয়ে যাওয়া, চুল পড়া, মুখে মেসতা, চুলকানা, পাঁচড়া, স্ট্রোক, হাই প্রেশার, লো-প্রেশার, এলার্জি, জরায়ু ঘা, জরায়ু ক্যান্সার, ধাতু, ডায়াবেটিস, আমাশয়, জন্ডিস, সর্দি কাশি, জ্বর, টনসিল, এ্যাজমা, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া ও স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া।’
সোনাভানু (৬৮) বলেন, ‘লবণাক্ততা বাড়ার ফলে নারীদের নানা ধরনের রোগব্যাধি যেমন বেড়েছে তেমনি, নারীদের সংসারের কাজও বেড়েছে দ্বিগুন। আমাদের ঘরবাড়ি তো মাটির তৈরি। এখন এসব ঘরবাড়িতে লবণের কারণে মাটি ঝুরঝুরে হয়ে ধুলা উড়ে। তাই এর হাত থেকে বাঁচতে আমাদের এক দুই দিন পর পর সারা ঘর লেপা লাগে, উঠান ও লেপা লাগে। আগে পনেরো দিনে একবার কাপড় চোপড় পরিষ্কার করা লাগতো। কিন্তু এখন সপ্তাহে দুই বার পরিষ্কার করা লাগে। ফলে সকল জিনিসের রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং টিকছেও খুব কম।’
মোনোয়ারা খাতুন (৬৫) বলেন, ‘হাঁড়ি কড়াইও বেশি বেশি মাজা লাগে। আগে প্রায়ই পুকুরের পানি ভালো ছিল তাই পানি আনার দুরত্ব কম ছিল কিন্তু এখন এক কিলোমিটার দুর থেকে পানি আনতে হচ্ছে। এবং এই পানি আনতে অনেক সময় ধরে অপেক্ষাও করতে হয়। আর এই দূরে পানি আনতে যাওয়ার কারণে আমাদের বাচ্চাদের বাড়িতে অন্যের কাছে রেখে যেতে হয়। এভাবে কয়েকজনের বাচ্চা জলে ডুবে মারাও গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে জ্বালানি নিয়েও নারীদের বেড়েছে খুব জ্বালা। এখানের সবাই বনের কাঠের উপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু এখন বনে যাওয়া নিষেধ। তাই অধিকাংশই বনের ভেসে আসা ফল ও পাতা ধরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে।’
অংশগ্রহণকারীরা জানান, লবণাক্ততা বৃদ্ধি নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন অধিকাংশ নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। আগে যেমন প্রত্যেক বাড়িতে দুধ, ডিম, মাছ, শাকসবজি ছিল এখন তা আর নেই। এখন সবকিছু বাজার থেকে কিনে খেতে হচ্ছে, তাও বিষ সারের তৈরি। তাই বেড়ে যাচ্ছে রোগ ব্যাধি। তারা আরও জানান, যাদের বাচ্চা হচ্ছে তাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। খুব বেশি লবণ পানি ব্যবহারের কারণে অল্প বয়সে জরায়ু ক্ষত, চুলকানি হতে হতে এক পর্যায়ে জরায়ু ক্যান্সারে পরিণত হচ্ছে। আর কেউ কেউ এ থেকে মুক্তির জন্য, যখন প্রাথমিকভাবে সমস্যা তৈরি হয় তখন দ্রুত জরায়ু অপারেশন করে ফেলছেন। এভাবে নারীরা নানাবিধ সমস্যার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন।