‘আছড়ায়’ পচা ধান সংগ্রহ করছেন হাওরের ফসলহারা কৃষক
সুনামগঞ্জ থেকে শামস শামীম
“দুই আনা ধান পাকার পর পাইন্যে জাতা মারি আস্তা আওর নিছিলগি। পানির তলে যাইবার এক মাস পর পচা ধান এখন বাঁশ দিয়া ‘আছড়া’ বানাইয়া আইক্যা আনরাম। কিন্তু ইতা ধানো কোন মুরাদ নাই। মনের শান্তনার লাগি খররাম” (দুই আনা ধান পাকার পর পাহাড়ি ঢলের পানিতে পুরো হাওর ডুবে গিয়েছিল। হাওর তলিয়ে যাওয়ার একমাস পর সেই পচা ধান এখন বাঁশ দিয়ে চিরুনি বানিয়ে তুলেছি। কিন্তু এই ধানে তেমন লাভ নেই। শুধু মনের শ্বান্তনার জন্য এসব করছি’।
পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়া দেখার হাওরের পচা বোরো ধান পানির নিচ থেকে সংগ্রহ করে রাস্তায় তোলার পর এভাবেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন, গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন (৬০)। তার ৯০০ শতক জমির মধ্যে মাত্র ১৮০ শতক জমির ধান তুলতে পেরেছিলেন। এই পরিমাণ জমিতে ধান লাগাতে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এর মধ্যে সাকুল্য ১৮ হাজার টাকার ধান তোলতে পেরেছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষক আবুল হোসেন একটি ছোট নৌকা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে তলিয়ে যাওয়া ক্ষেত থেকে পচাধান সংগ্রহ করে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের মদনপুর নামক স্থানে জড়ো করছেন। তার স্ত্রী মনমালা বিবি সেই পচা ধান রোদে নেড়ে দিচ্ছেন। তাদের মতো আশপাশের গ্রামের অর্ধ শতাধিক কৃষক পরিবারকে দেখা গেল বাঁশের তৈরি আছড়ায় রোদে পোড়ে এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় পচাধান ধান সংগ্রহ করছেন।
কৃষকরা জানান, পাহাড়ি ঢলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে, অকাল বন্যায় বাঁধ উপচে প্রতিবছরই হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে যায়। তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান প্রায় মাসখানেক পর পানির নিচে থেকে পচে গেলে বাঁশের স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘আছড়া’ ‘ছাবড়া’ বানিয়ে সংগ্রহ করেন কৃষক। শিল্পী যেভাবে পটে নিমগ্ন শিল্পকর্ম আঁকাআঁকি করেন ঠিক এভাবেই ক্ষেতকে পট বানিয়ে ‘আছড়া’য় এবরোথেবরো আঁকাআঁকি করে পচা ফসল সংগ্রহ করেছেন কৃষকরা। সুনামগঞ্জের কৃষি সমাজে এটা ‘আছড়া’ ‘ছাবড়া’ দিয়ে ‘আঁকা’ বলা হয়।
প্রতিবছরই এই প্রক্রিয়ায় ফসলহারা কৃষক এভাবে ধান তোলেন। শুধু জমির মালিকই নয় হাওর এলাকার দরিদ্র মানুষজনও এই প্রক্রিয়ায় ধান সংগ্রহ করেন। এতে কৃষকরা কোন বাধা দেন না। তবে আছড়ার ধান তুলেও তেমন লাভ না হলেও দরিদ্র মানুষজন কিছুটা হলেও লাভবান হন।
কৃষকরা জানান, গত ২৩ এপ্রিল দেখার হাওর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায়। ওই সময় মাত্র তিনভাগের এক ভাগ ফসল পেঁকেছিল। বাকি ফসল কাটার আগেই পুরো হাওর দেখতে দেখতে একদিনেই তলিয়ে যায়। এতে ওই হাওরের প্রায় ২শ’ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেখার হাওর চলতি বছরে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল। সরকারি হিসেবে ৩০ ভাগের মতো জমি পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতির কথা স্বীকার করা হলেও বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০ ভাগ।
দেখার হাওরপাড়ের লালগোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান (৬৫) বলেন, ‘২৩ এপ্রিল পারাসহ ক্ষেতের বোরো ধান পাইন্যে লইয়া গেছে। ৯০০ শতক জমিনের মাঝে মাত্র ১৫০ শতক জমির কাচাপাকা ধান তুলছিলাম। এখন পেটের জ্বালায় পচা ধান আছড়া মাইরা আকরাম। আছড়া দিয়ে তোলা ৫ মণ ধানে এক মণ চাউলও অয়না (গত ২৩ এপ্রিল কাটা ধানের স্তুপসহ ক্ষেতের ধান পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, “৯০০ শতক জমির মধ্যে মাত্র ১৫০ শতক জমির কাঁচাপাকা ধান তুলতে পেরেছিলাম। এখন পেটের জ্বালায় ডুবে যাওয়া পচা ধান বাঁশের চিরুনি দিয়ে তোলছি।” তবে ৫ মণ ধানেও একমণ চাল হয় না বলে তিনি জানান। তিনি জানান, চলতি মওসুমে বোরো লাগাতে তাঁর এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার টাকার ধান তোলতে পেরেছিলেন ওই কৃষক।
একই হাওরের নীলপুর গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আঁকির নাম ফাঁকি। ইতা ধানে কোন উফা দেয় না। এক নৌকা ধান তোললে দুই ফোরা ধান অয় না। দেখার আওরের হখল কৃষকেরই অনেক ক্ষতি অইছে। কৃষকরার লাগি সরকারের কুন্তা খরা উচিত’ (বাঁশের চিরুনি দিয়ে ধান তোলা ফাঁকির মতো। এই ধানে কোন লাভ নেই। এক নৌকা ধানে মাত্র ১২-১৫ কেজি ধান অয়। দেখার হাওরের সকল কৃষকের এবার বিরাট ক্ষতি হয়েছে। সরকারের উচিত তাদের জন্য কিছু করা।)
সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বদরুল কাদির শিহাব বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির কারণে এবার সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ হাওরের ফসল পাকার আগেই তলিয়ে গেছে। বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষক। দেখার হাওরের কৃষকদের বেশিরভাগ জমিই তলিয়ে গিয়েছিল। এখন পচা ধান স্থানীয় প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করছেন কৃষক। এতে তেমন লাভ হচ্ছে না। তবে মনের শান্তনার জন্য যুগযুগ ধরেই এটা করেন কৃষক। তবে দরিদ্র কৃষকরা এতে উপকৃত হয়।”
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, “বিভিন্ন সময়ে বোরো মওসুমে সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢলে কৃষকের পাকা ফসল তলিয়ে যায়। পানির নিচে ধান পচে যাওয়ার পর কৃষকরা সেগুলো বাঁশ দিয়ে বিশেষ যন্ত্র বানিয়ে সংগ্রহ করেন। তবে এতে তেমন লাভ হয় না।”