‘হেকিম ধান’র জয় জয়কার
নেত্রকোনা থেকে মো. নূরুল হক
ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সাধুপাড়া গ্রামসহ ছয়টি গ্রামে চলতি আমন মৌসুমে ‘হেকিম ধান’ তথা M-394-1 জয়জয়কার। চলতি আমন মৌসুমে কামারিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের কৃষকরা বৈচিত্র্যময় জাতের ধান চাষ করেছেন। কৃষকদের চাষকৃত ধানের জাতগুলোর মধ্যে- ব্রি-৪৯, ব্রি-৩৪, ব্রি-৭১, মাধবী, বোরআবজি, লালকুমড়ি, হরি, কালিজিরা, সুবাস ও হেকিম বা M-394-1. কৃষকদের চাষকৃত ১০টি ধানের জাতের মধ্যে এলাকার কৃষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে হেকিম ধান নামে পরিচিত M-394-1ধানটি। বিশেষভাবে ভালো ফলন, রোগবালাই কম, হেলে পড়েনা, ধান মাঝারি মোটা, নিচু জমিতেও হয় ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের জন্য ধানটি এলাকার কৃষকদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে হেকিম ধান বা M-394-1 ধানের চাষাবাদ পদ্ধতি ও এর ফলন এলাকার কৃষকদের সাথে সহভাগিতার জন্য সাধুপাড়া কৃষক ঐক্য’র উদ্যোগে এক কৃষক মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। কৃষক মাঠ দিবসে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ফজলুল হক মেম্বরসহ ৬টি গ্রামের ১৫ জন আগ্রহী কৃষক অংশগ্রহণ করেন। মাঠ দিবস অনুষ্ঠানে এলাকায় ধানটির প্রথম চাষী কৃষক আব্দুল হেকিম M-394-1 ধানের চাষ পদ্ধতি, লাভ-ক্ষতি ও উপকারিতা সম্পর্কে উপস্থিত কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করেন। কৃষক আব্দুল হেকিম বলেন, ‘আমি ২০১৬ সালের অমন মৌসুমে বারসিক সংস্থা থেকে ১৫টি ধানের জাত নিয়ে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনের জন্য কৃষকদের নিয়ে একটি জাত গবেষণা স্থাপন করি (প্রায়োগিক গবেষণা)। ধান পাকলে একটি মাঠ দিবস আয়োজন করি। মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ৬ জন কৃষক ১৫টি জাতের মধ্যে M-394-1 ধানের জাতটি এলাকা উপযোগি জাত হিসেবে বাছাই করেন। আমারও এ জাতটি খুব পছন্দ হয়। ২০১৭ সালের আমন মৌসুমের জন্য ৬ জন কৃষক এ ধানের বীজ নিয়ে যায় এবং আমি নিজেও ৮ কাঠা (৮০ শতাংশ) জমিতে চাষ করেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ আমন মৌসুমেও আমি আমার জমিতে এই ধানটি চাষ করে ভালো ফলন পাই। গ্রামের এবং অন্য গ্রামের কৃষকরা আমার কাছ থেকে M-394-1 ধানের বীজ কিনে আবার কেউ কেউ বদল করে নিয়ে যায় ২০১৯ আমন মৌসুমে রোপণের জন্য। এই ধানে তেমন কোন রোগবালাই না হওয়ায় এবং অন্যান্য ধানের চেয়ে (ব্রি-৩২, ব্রি-৪৯) কম সময় ও ফলন বেশি হওয়ায় অনেক কৃষক ২০২০ আমন মৌসুমে এ ধানের চাষ করেছেন। ধানটি আমিই প্রথম এই এলাকায় চাষ করেছি। ধানের নামটি মনে রাখতে না পারায় সবাই এই ধানটিকে ‘হেকিম ধান’ নামেই ডাকছে। আগামীতে এধানটি পুরো এলাকা ছড়িয়ে যাবে বলে আমি আশ করছি।’
কৃষক আব্দুল বারি বলেন, ‘এবছর সাধুপাড়া গ্রামসহ ৫টি গ্রামের (সাধুপাড়া, কোদালিয়া, ইসলামপুর, নগুয়া, দয়ারামপুর) ৩২ জন কৃষক তাদের ১১২ কাঠ (১ কাঠা=১০ শতাংশ) বা ১১.২০ একর জমিতে হেকিম ধান বা M-394-1 ধান চাষ করেছেন। আমার জমিতে M-394-1 ধান কাঠ প্রতি (প্রতি ১০ শতাংশে) ৬ মন পর্যন্ত ফলেছে।’ এ ধানের জাতটি পছন্দের কারণ হিসেবে যুব কৃষক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘উচ্চতা মাঝারি হওয়ায় হেলে পড়েনা, রোগ-বালাই হয়না, লম্বা শীষ ও দানার গাঁথুনি ঘন, স্বল্প সময়ে হয় (বীজতলা থেকে-কাটা পর্যন্ত ১২৫ দিন), ব্রি-২৮ ধানের মত চিকন, নামা/নিচু জমিতে ভালো ফলে, সার কম লাগে এবং অন্যান্য ধানের চেয়ে ফলন ও খেতেও ভালো। তাই এ ধানের জাতটি দিন দিন কৃষকদের নিকট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’
ধানের পরিচিতি
হেকিম ধান নামে পরিচিতি পাওয়া M-394-1 ধানটির অরজিন হল ফিলিপাইন। ফিলিপাইনের কৃষকরা সংকরায়ণের (ব্রিডিং) মাধ্যমে এ ধানের জাতটি আবিস্কার করেন। বারসিক ও কারিতাস বাংলাদেশ’র সহযোগিতায় এদেশের বেশ কয়েকজন কৃষক ফিলিপাইন সফরে গিয়ে ‘মেসিপ্যাগ’ নামের এক কৃষক সংগঠন থেকে কৃষকদের সংকরায়ণের মাধ্যমে উন্নয়নকৃত বেশকিছু ধানের জাত সংগ্রহ করে নিয়ে এসে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামে আমন মৌসুমে কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা করেন। গবেষণা প্লটে M-394-1 জাতটি ভালো ফলন দেয়। পরবর্তীতে স্থানীয় ধানের জাতগুলোর সাথে ফিলিপাইন থেকে সংগৃহীত যেসব জাত নেত্রকোনার আবহাওয়ায় ভালো ফলন দিতে সক্ষম, সেব জাতগুলো গ্রাম পর্যাায়ে গবেষণার জন্য কৃষক সংগঠনগুলোকে প্রদান করা হয়। ‘সাধুপাড়া কৃষক ঔক্য’ ২০১৬ আমন মৌসুমে বারসিক অফিস থেকে ১৫টি জাত সংগ্রহ করে কৃষক আব্দুল হেকিম এর নেতৃত্বে একটি প্রায়োগিক গবেষণা স্থাপন করে। ধান পাকার পর কৃষক মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা M-394-1 জাতটি এলাকা উপযোগি হিসেব বাছাই করে এবং ক্রমে এ জাতটি কামারিয়া ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলোতে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কৃষকরা M-394-1 মনে রাখতে না পারায় এবং কৃষক আব্দুল হেকিম এই ধানের জাতটি এলাকায় প্রথম চাষ করায় ও তারই মাধ্যমে এলাকায় সম্প্রসারিত হওয়ায় এলাকায় এ ধানটি ‘হেকিম ধান’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে।
বর্তমানের আধুনিক কৃষির যুগে অধিকাংশ কৃষক যেকোন শস্য ফসলের বীজের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল। বাজার থেকে বীজ কিনে চাষ করায় কৃষকরা সেসব বীজ দিয়ে চাষাবাদ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাজারের বীজে চাষাবাদ করায় ফসল বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগবালাই দমন করতে
কৃষকদেরকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশকসহ বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করছে, ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরচ অনুযায়ী কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারছেনা। অন্যদিকে রাসায়নিক কীটনাশক বেশি ব্যবহার করায় উৎপাদিত ফসল জনস্বাস্থের জন্য হিতকর হচ্ছেনা, ভোক্তা বঞ্চিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্যের অধিকার থেকে। কৃষক আব্দুল হেকিমসহ এলাকার কৃষকদের ধারণা যেহেতু এ ধানটির বীজ সংরক্ষণ করা সহজ, ফলন ভালো, নিচু জমিতেও চাষ করা যায় হেলে পড়েনা, ধান চিকন ও খেতে ভালো, বাজার মূল্যও ভালো এবং লিফ ব্লাস্ট, নট ব্লাস্ট, নেক ব্লাস্ট রোগ হয়না, মাজরা ও গন্ধি পোকার আক্রমণ হয়না বলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। তাই M-394-1 ধানের জাতটি পেয়ে কৃষকরা এখন জয়জয়কার করছে।