হাঁসের খামার ভিন্নভাবে সক্ষম রহিস মিয়াকে স্বাবলম্বী করেছে
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও উৎসাহ পেলে ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরাও যে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজের মাধ্যমে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনয়নে ভূমিকা রাখতে পারে তা প্রমাণ করলেন নত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বালি গ্রামে বাক্ প্রতিবন্ধী রহিস মিয়া (৩৫)। মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানসহ পাঁচজনের অভাব অনটনের সংসার। স্ত্রী ময়না আক্তার অন্যের বাড়িতে কাজ করে পরিবারের খরচ বহনে স্বামীকে কিছুটা হলেও সাহায্য করেন। অভাবের তাড়নায় একমাত্র মেয়েটিকে অল্প বয়সেই বিয়ে দেন। দুই ছেলে পড়াশুনা ছেড়ে অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে। অভাব অনটন আর দুঃখ-দুর্দশা রহিস মিয়ার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। বালি গ্রামে অক্সিজেন যুব সংগঠন বাক্ প্রতিবন্ধি রহিস মিয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। সংগঠনটি রহিস মিয়ার পারিবারিক আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাঁসের খামার করার জন্য ৩০টি হাঁসের বাচ্চা দিয়ে সহযোগিতা করে। এছাড়াও সংগঠনের অন্যতম সদস্য আকাশ ও ইমরান’র সহযোগিতায় রহিস মিয়ার স্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ পেতে সহযোগিতা করায় ঋণের টাকায় তারা হাঁসের খামারের কাজ শুরু করেন। খামার গড়ে তোলার পর থেকে ধীরে ধীরে পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে।
রহিস মিয়া একটি মুরগি দিয়ে হাঁেসর ডিমে তা দিয়ে আরও ২০টি হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করেন। বাচ্চাগুলো বড় হয়ে ১৫টি হাঁসী ও ৫টি হাঁস হয়। হাঁসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০টি (৩০+২০), ৩৫টি হাঁসি একই সময়ে ডিম দেওয়া শুরু করলে পরিবারের সদসদের মুখে আনন্দের হাসি দেখা দেয়। শুরু হয় রহিস মিয়ার অভাব-অনটন থেকে ঘুড়ে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের। হাঁসগুলো একাধারে ছয় মাস পর্যন্ত ডিম দেয়। স্ত্রী ময়না আক্তার গ্রামীণ ব্যংকের ২০ হাজার টাকার ঋণ ডিম বিক্রির টাকায় কিস্তিতে পরিশোধ করেন। ঋণের টাকা পরিশোধ হওয়ার পর তিনি ডিম বিক্রির টাকা জমিয়ে আরও ১০০টি হাসেঁর বাচ্চা কিনে খামারটি বড় করেন। তিনি বাচ্চাগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করার ফলে বাচ্চাগুলো দ্রুত বেড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে যুব সংগঠনের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী রহিস মিয়া নেত্রকোনা সদর উপজেলায় প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে সপ্তাহব্যাপী ‘হাঁস-মুরগি প্রতিপালন’র উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। প্রশিক্ষণের ফলে হাঁস-মুরগি প্রতিপালন বিষয়ে জ্ঞন ও অভিজ্ঞতা লাভের ফলে তিনি আরও বড় আকারে খামার করার সাহস পায়। তিনি আরও ২০০টি হাঁসের বাচ্চা কিনে ছেলেদেরকে হাঁসের খামারের কাজ লাগান এবং পুনরায় স্কুলে ভর্তি করেন। হাঁসের খামারকে কেন্দ্র করে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রহিস মিয়া ও ময়না আক্তারের পরিবার। তার হাসেঁর খামারে বর্তমানে আটশত হাঁস রয়েছে। খামার থেকে সে প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০টি ডিম পায়। বর্তমানে হাঁসের ডিমের বাজার মূল্যও ভালো, ডিমের বর্তমান বাজারের মূল্য ৪০-৪৫ টাকা হালি। ডিম বিক্রি থেকে প্রতিদিন গড়ে তার আয় হচ্ছে প্রায় ১৫শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। হাঁসের খাবার ও চিৎিসায় ঔষধ বাবদ খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন তার ভালোই আয় থাকে।
এ বিষয়ে রহিস মিয়ার স্ত্রী ময়না আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী প্রতিবন্ধী মানুষ, কাজ করার শক্তি ও সামর্থ্য কম থাকায় অনেক অভাব অনটনের মধ্যে সংসার চালাতে হতো। আমাদের বাড়িভিটা ছাড়া অন্য কোন সম্পদও নেই। কিন্তু খামারটি করার পর থেকে আমাদেরকে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। নিজের বাড়িতেই হাঁসের খামারের কাজে সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটে। হাঁসের খামারের আয়ের টাকায় আমি একটি ছোট টিনের ঘর করেছি এবং ২০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় শাকসবজি চাষ করছি। আমি বেশিরভাগ সময় নিজের চাষ করার শাকসবজি খাই। আমি গ্রামের অক্সিজেন যুব সংগঠন’র সদস্যদের মন থেকে দোয়া করি, তারা যেন সমাজের প্রতিবন্ধী, প্রবীণ ও অসহায় গরীব মানুষের পাশে সবসময় দাঁড়াতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রাণী সম্পদ অফিসে কোন ভ্যাকসিন নেই থাকলেও দাম অনেক বেশি, তাই সঠিক সময়ে হাঁসের জন্য ঔষধ ও ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না। হাঁস-মুরগির চিকিৎসা ও ভ্যাক্সিনেশন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে হাঁসের খামার করতে আরো অনেকেই এগিয়ে আসবে।’ ময়না আক্তার এবং রহিস মিয়া নিজে গ্রামের অন্য নারীদেরকে ঘরে বসেই গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি আয়বৃদ্ধিমূলক কাজের মাধ্যমে পারিবারিক আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছেন। ময়না আক্তার আরও বলেন, ‘আমাদের এখন প্রতিবছর ভালো টাকা আয় হয়, খামার থেকে আয়ের টাকায় এখন আমার গোয়ালে দু’টি গরু ও একটি ছাগল হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে ভালোলাগা হলো আমারা দুই ছেলেকে আবার লেখাপড়া করাতে পারছি। সামান্য সহযোগিতা পেলে এবং একাগ্রচিত্তে পরিশ্রম ও চেষ্টা থাকলে আমার মত গ্রামের অন্য পরিবারগুলো হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন করলে পরিবারের স্বচ্ছলতা আসবেই।
বালি অক্সিজেন যুব সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে দেয়া ৩০টি হাঁসের বাচ্চা রহিস মিয়ার পরিবারের উন্নয়নের চাকাকে ঘুড়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছে। যুব সংগঠনের সহযোগিতায় একটি অস্বচ্ছল ভিন্নভাবে সক্ষম পরিবারকে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অভাব অনটন থেকে মুক্ত করেছে এবং দু’জন দিনমজুর শিশুকে পুনরায় স্কুলগামী করেছে। পরিবারেিক একটি খামারের মালিকে পরিণত করেছে। আমরা রহিস মিয়া ও অক্সিজেন যুব সংগঠনের সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করি।