শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেন কৃষাণী নাজমা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের পাঁচকাহনীয়া গ্রামের কৃষাণী সংগঠনের সদস্য নাজমা। স্বামী কাঠ মিস্ক্রির দোকানে চাকরি করেন। দোকানে কাজের উপর বেতন যা পান তা দিয়ে দুই ছেলে শ^শুর শাশুরিকে নিয়ে এক ধরনের নিয়ম মেনে সংসার চালাতে গিয়ে খুব কম বয়সে নাজমা বুঝতে পারেন একটু পরিবর্তন আনতে হলে তাকে কিছু না কিছু করে পরিবারের আয় বাড়াতে হবে। তাই নিজের বাড়ির চারপাশের পতিত জায়গায়কে সম্বল হিসেবে বেছে নেয়। বাড়ির চার পাশে এক ইঞ্জি জমি খালি রাখেননি তিনি। বাড়ির সামনে ছোট মাচা তৈরি করেছেন। নিজেই সেখানে মৌসুম অনুযায়ী সবজি চাষ করেন সিম, লাউ, কুমড়া, জিঙ্গা, চিচিঙ্গা ইত্যাদি।
মাচার নিজে কখনো ডাটা কখনো পাটশাক রোপণ করেন। এর সাথে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া চাষ করেন। এ সম্পর্কে নাজমা বলেন, ‘যাই হয় নিজে চলতে পারি, বাজারে যাতে যাওয়া না লাগে সে চেষ্টা করি সব সময়।’বাড়ির চারপাশে স্থানীয় জাতের ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁপে, নারকেল, সুপারি, বড়ই, লেবু, চালতা, কলা ইত্যাদি গাছ রয়েছে, যা পরিবারের চাহিদা পূরণ করে, প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করে। মাঝে মাঝে কিছু বাজারে বিক্রি করে এতে করে কিছু বাড়তি আয় হয় তাঁর।
সামাজিক কাজে আগ্রহী নাজমা নিজেই আগ্রহ করে গ্রামের কৃষাণীদের নিয়ে পাঁচকাহনীয়া কৃষাণী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। সংগঠনের সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বারসিক। কৃষাণী সংগঠন ও বারসিক’র সহায়তা সংগঠনের সদস্যদের সাথে গৃহপালিত পশুর যতœ বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। গত বছর নিজের পালন করা একটি ষাঁড় নব্বই হাজার টাকায় বিক্রয় করেন। বর্তমানে সারাবছর বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু পালন করছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার উপর নির্ভর করে হাঁস, মুরগির ৮০ ভাগ মড়ক বন্ধ করা যায়। প্রশিক্ষণে এ বিষয় গুলো গুরুত্ব সহকারে শিখানো হয়েছিল যা আমার জীবনে অনেক কাজে লেগেছে।’
তিনি স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহকারী-সবজি চাষের সাথে সাথে নাজমা সিম, কুমড়া, ডাটা, করলা, ইত্যাদি বীজ সংগ্রহ করেন। নিজে রোপণ করে প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করে থাকেন, যা গ্রামের অনেক নারীর মধ্যে সবজি চাষ ও বীজ সংগ্রহে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
গত বছর করোনার কারণে নাজমার স্বামী যে দোকানে কাজ করতেন সেখানে কাজ কমে যাওয়ায় বেতন কমে যায়। নাজমার মতো গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবার পেশা হারিয়ে আরও দরিদ্র হয়ে পড়েন। বিশেষ করে যারা নেত্রকোনার সদরে দোকানগুলোতে কাজ করতেন। খেটে খাওয়া গ্রামের সাধারণ পরিবারগুলো মধ্যে এক ধরনে চাপা হতাশা সৃষ্টি হয়। তবে কঠোর মনোবলের অধিকারী নাজমা ভেঙ্গে পড়েননি। নিজেই কাজ খুঁজতে থাকেন। শহরের দোকান বন্ধ থাকলেও গ্রামে দোকান খোলা থাকতো। গ্রামের বাজারে একটি ছোট কারখানা রয়েছে সেখানে নাড়ু, চানাচুর, আচার ইত্যাদি তৈরি করে বিক্রয় করা হয়। কারখানায় গ্রামের কিছু নারী কাজ করেন। কিন্তু গ্রামের অনেক নারী যারা কাজ করতে চায় কিন্তু পারিবারিক কারণে বাড়ির বাইরে যেতে না পারায় নাজমা তাদের নিয়ে বাড়িতে বসে নাড়ু তৈরির পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু পুঁজি না থাকায় পরিকল্পনা পরিবর্তন করে। পুঁজি ছাড়া উপকরণ কেনা যেমন সমস্যা সেই সাথে প্রথম অবস্থায় বাজারে বিক্রয় করা কঠিন ভেবে কারখানা থেকে উপকরণ এনে বাড়িতে বসে বিক্রয় করে কিছু আয় করার সিদ্ধান্ত নেন। নাজমা নিজেই কারখানার মালিকের সাথে যোগাযোগ করে বাড়িতে বসে নাড়ু ,আচার তৈরি করে কারখানায় পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কারখানার মালিক নাজমার আগ্রহ দেখে সীমিত পরিমাপের নাড়ু তৈরির উপকরণ দেয় প্রথম অবস্থায়।
নাজমা ছেলেবেলা থেকে রান্না, পিঠা, তৈরির কাজে দক্ষ ছিলেন। কারখানা একবার দেখে এসে নিজ বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ভালো মানের নাড়ু তৈরি করতে থাকেন। কিছু দিনের মধ্যে এ কাজ করে গ্রামের ১০ থেকে ১২টি দরিদ্র পরিবারের নতুন করে কিছু আয় করতে থাকে। বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে নাড়ু তৈরি, চানাচুর প্যাকেট করা, বড়ই, তেতুলের আচার তৈরি করে দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় কওে তাঁর গ্রামোর নারীরা।
অন্যদিকে নাজমার সীমিত জায়গায় সবজি চাষ, নিজের কঠোর পরিশ্রমে বাড়িতে পশু পালন যেমন গ্রামের অনেক নারীর মাঝে পতিত জমি কাজে লাগাতে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে সেই সাথে নাড়ু, চানাচুর, আচার তৈরির করে কিছু আয় করতে পারায় প্রতিদিন নতুন নতুন নারী যুক্ত হচ্ছেন ওই কাজে। পরিস্থিতি বদলালে ভবিষ্যতে ছোট করে একটি কারখানা তৈরির পরিকল্পনা আছে নাজমার। যেখানে নারীরা বাড়ির কাজ শেষ করে অবসর সময়কে কাজে লাগাতে পারবেন।
নাজমার মতো আমাদের সমাজে হাজারও নারী রয়েছেন যারা পরিবারের সংকট মুর্হুতে নিজের জ্ঞান, শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের সংকট মোকাবেলা করে সফল হন। এরকম নারীরা নিজে ভালো থাকতে চান সেই সাথে অন্যকে ভালো রাখতে চান।