আসুন আমরা প্রকৃতিকে ভালোবাসি
নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি, ফজলে রাব্বি, সোহেল রানা, নির্মল চন্দ্র দাস ও পার্বতী রাণী সিংহ
প্রকৃতির করুণা ও দান ছাড়া মানুষ কখনও বেঁচে থাকতে পারে না। অকৃপণ হাতে প্রকৃতি মানুষকে খাদ্য, পুষ্টি, ওষুধ, জ্বালানি, ফল, ফুল, আসবাবসহ নানান উপাদান দিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে পরিপূর্ণ করেছে। কিন্তু মানুষ কখনও প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। বরং দিনকে দিন মানুষ থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। প্রকৃতি থেকে দুরে সরে যাওয়ার কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। নিত্যনতুন দুর্যোগ ও আপদ মানুষের জীবনকে তছনছ করছে। অথচ জন্মের পর থেকে মানুষ প্রকৃতিই মানুষ বাঁচিয়ে রাখে, প্রকৃতিই মানুষকে নানান বিষয়ে শিক্ষা দান করে। আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে মানুষের জীবনকে নিরাপত্তা বেস্টনী আবদ্ধ রাখে এই প্রকৃতিই। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং মানুষের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবে কারণে আজ নতুন প্রজন্মরা প্রকৃতিকে জানে না, প্রকৃতির দান সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রকৃতিকে নতুন করে পরিচিত করানো এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর জন্য নেত্রকোনায় সম্প্রতি ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তরুণরা। এই লেখাটির উপজীব্য হচ্ছে তরুণদের এই ভিন্ন ও নতুন মাত্রার উদ্যোগসমূহ।
প্রাণ ও প্রকৃতিকে জানি
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার নইদ্যা একতা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে পরিবেশ প্রতিবেশ জানা, গাছ চেনা, ঔষধি গাছ চেনা, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য সামগ্রী চেনার জন্য গ্রামের সুমন কবিরাজ এর বাড়ি প্রদর্শন করে এবং সেখানে সারাদিন অবস্থান করে। কবিরাজের কাছ থেকে বিভিন্ন উদ্ভিদের নাম, লতাপাতার নাম উপকারিতা, ওষুধি গাছের নাম, কোন রোগে কোন ওষুধি গাছের ওষুধ ব্যবহৃত হয় তা জানার চেষ্টা করে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা নইদ্যা গ্রামে কবিরাজ বাড়ি, পাখির অভয়ারণ্য ঘুরে ঘুরে দেখে। সুমন কবিরাজের সাথে আলোচনায় শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়িতে ফলের গাছ,ঔষধি গাছ রোপণের জন্য ও বাগান তৈরি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। সুমন কবিরাজও তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন ও কৌশল শেখান। এই প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী রাব্বী বলে, “আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে ফুলের বাগান করা উচিত। আমাদের জীবনের জন্য পুষ্টির জন্য ফলের গাছ লাগানো দরকার।” এই পরিদর্শন শেষে নইদ্যা একতা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আ: কাদির প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনটি করে ফলের গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করেন। এভাবেই দেশের প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরিবেশ নিয়ে ভাবতে শিখবে এবং প্রকৃতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে শিখবে।
গাছ রোপণ করি, ভালো থাকি
আটপাড়া উপজেলায় একটি বৃক্ষমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য এই মেলা। এ সময় আটপাড়া যুব সমাজ একটি অভিনব উদ্যোগ নেয়। তারা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার জন্য মাবনবৃক্ষ তৈরি করে। মেলায় আগত শত শত মানুষকে তারা এই বার্তা দিতে চায় যে, মানুষের জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য গাছ অতীব প্রয়োজন। প্রতীকী বৃক্ষমানব তাপস ও হৃদয় র্যালির সামনে দিয়ে মানুষকে বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা, গাছ ও প্রাণীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তুলে ধরেন। যুব সমাজ মেলা প্রাঙ্গণে গাছ রোপণ করে গাছের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তারা রঙবেরঙের কাগজে লিখেন ‘গাছ আমাদের পরম বন্ধু’, ‘গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়’, ‘কার্বন শোষণ করে’, ‘একটি গাছ একটি ঔষধ কোম্পানি’, ‘গাছ ছায়া দেয়, দুর্যোগ কমায়’ ইত্যাদি জাতীয় স্লোগান। এভাবে মেলায় আগত শিক্ষার্থীসহ গাছের উপকারিতা ও প্রযোজনীয়তা জানতে পারেন ও গাছ রোপণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
জীবে প্রেম করি
পাখির প্রতি ভালোবাসাস্বরূপ নেত্রকোনা যুবকরা আটপাড়া উপজেলা ক্যাম্পাস, খাজান্তির শতবর্ষী বটগাছ, কেন্দুয়ার নোয়াদ্যা গ্রামের শতবর্ষী গাছ ও বিচিপাড়ার কৃষক আ. রশিদ ফকিরের বাড়িকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে তৈরি করেছেন। আটপাড়া উপজেলার মঙ্গলসিদ্ধ গ্রামের যুবকরা খাজান্তির শতবর্ষী বটগাছে ৮০টি মাটির কলসি বেঁধে দিয়ে পাখির নিরাপদ আশ্রয় স্থাপনে সহযোগিতা করেছেন। একইভাবে কেন্দুয়া উপজেলার নোয়াদ্যা গ্রামের যুব সংগঠন ও গ্রামবাসী শতবর্ষী বটগাছ ও আমগাছ ও জারুল গাছে দু’শ’ মাটির কলসি বেঁধে দিয়ে পাখির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আটপাড়া সম্মিলিত যুবসমাজ ও শিক্ষা সংস্কৃতি বৈচিত্র্য রক্ষা টিম ও আটপাড়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১০০ শত মাটির কলসি উপজেলা চত্বরে ও আটপাড়া শিশুপার্কের গাছে বেঁধে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই; পাখির নিরাপদ প্রজননে সহায়তা করা।
এছাড়াও নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিচিপাড়া গ্রামের যুবকরা ও গ্রামবাসী মিলে কৃষক আ: রশিদের বাড়িতে বসবাসরত শত শত পাখি যাতে নিরাপদে থাকতে পারে তার জন্য বাড়িটিকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে সেখানে কোন পাখি শিকারিকে ঢুকতে দেন না। উল্লেখ্য যে, এই বাড়িটিতে আশ্রয় নেওয়া শত শত পাখি ভোর বেলায় চলে যায় খাদ্য সন্ধ্যানে। তবে বিকেলে আবার ফিরে আসে। এ যেন পাখির নিরাপদ ভালোবাসার ঘর! পাখিগুলো রক্ষার করার জন্য সেই বাড়ির পাশেই বিচিপাড়া ও মৌজেবালী যুব সংগঠনের একটি সাইনবোর্ড। যাতে লেখা ‘আপনাদের প্রয়োজনেই আমাদের বাঁচান। আমরা পরিবেশ রক্ষা করি, আমরা কৃষক ও প্রকৃতির বন্ধু, আমরা মানুষকে রোগ থেকে মুক্ত রাখি। শিকারিদের হাত থেকে ও বিষ কীটনাশকের কবল থেকে আমাদেরকে বাঁচান’।
প্রকৃতি ও প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে ভালোবাসার একটি অনন্য নির্দশন রেখেছেন এই যুবকরা। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার যুবকসহ অন্য বয়সের মানুষ যদি এইভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের সহ-অবস্থানকে স্বীকার করেন এবং সর্বোপরি প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টিকে ভালোবাসেন তাহলে আমাদের দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে আর্বিভূত হবে।