প্রাণবৈচিত্র্য ও নারী

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বৈচিত্র্যই শক্তি, বৈচিত্র্যই জ্ঞান। বৈচিত্র্যই জীবন। এই বৈচিত্র্য ও পারষ্পারিক নির্ভরশীলতা শ্রদ্ধাবোধের জায়গা তৈরি করে। মানুষের জীবন জীবিকা, উৎপাদন সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। বৈচিত্র্য আছে বলেই আমাদের জীবন এত সুন্দর।আর এই সৌন্দর্য্য রক্ষার কারিগর হচ্ছেন আমাদের দেশের নারীগণ।


বানিয়াজান ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের কৃষক কৃষাণী সংগঠনের নারী সদস্যগণ আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে তাঁদের উৎপাদিত ও সংরক্ষিত খাদ্য উপকরণের প্রদর্শনকরেন। সেখানে মোট ২৭ ধরণের উপকরণ দেখা যায়। উপস্থিত অংশগ্রহণকারীগণ তাঁদের উৎপাদিত ফসলের পুষ্টি ও গুণাগুন নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে সদস্য নাসরিন আক্তার বলেন, “আমরা(নারী) ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই পারি। এই প্রকৃতির সব উপাদান আমাদের জন্যই। এদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা যেমন সন্তান জন্ম দিতে পারি তেমনি মাটি ছিড়ে ফসলও ফলাতে পারি। আমাদের কারণে শুধু ফসল নয়, পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই রক্ষা পায়। কারণ আমরা সৃষ্টি করতে জানি, ধ্বংস নয়।’


তিনি আরো বলেন “উন্নয়নের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা বদলেছে। পরিবর্তন হয়েছে অভ্যাসেরও। কিন্তু সেই সঙ্গে সকলের অগোচরে যা হয়েছে, তা হলো আমাদের বৈচিত্র্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। আধুনিক কৃষির প্রাদুর্ভাবে অতিরিক্ত সার, কীটনাশক, উন্নত জাতের বীজদিয়ে চাষাবাদের ফলে মাটির গুনাগুন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদনও কমে যাচ্ছে।’


মাঠের ফসল উৎপাদনে কৃষকের মতামতের প্রাধান্য থাকলেও বসতবাড়ির আঙিনায় সেই জোড় খাটেনা। এই জায়গা পুরোপুরি নারীর দখলে। পরিবারের নারী সেখানে তাঁর সুবিধামতো ফসলের আবাদ করেন। একদিকে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ অন্যদিকে মৌসুমভিত্তিক ফসল চাষের মাধ্যমে বৈচিত্র্য রক্ষা করে চলেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সারা দেশে যখন ফসলের জন্য হাহাকার থাকে, সেখানে একজন নারীর আঙিনায় শোভা পায় নানা ধরণের ফসল। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব জ্ঞান ও চর্চার মাধ্যমে ফসল আবাদ চলমান রাখেন।


আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্থ মানুষের খাদ্যাভ্যাস যখন এমন হয় যে, কোন মৌসুমে কোন ফল পাওয়া যায় তা সঠিক জানেনা। সেখানে গ্রামের একজন নারী জানেন তাঁর আঙিনায় কোন গাছে, কোন সময়ে ফল ধরবে।
অসময়ে বা যখন কোনো খাবারের সংকট থাকে তখনও একজন নারী তাঁর শুকিয়ে সংরক্ষণ (মাছ, বড়ই, মূলা, জলপাই, আম) করে রাখা ফসল দিয়ে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেন।


আধুনিকযুগে যেখানেবাজারে গেলেই চোখে পড়ে প্যাকেটে ভর্তি বীজের সমাহার, সেখানে আমাদের গ্রামাঞ্চলের নারীরা নিজেদের মতো করে বৈয়ামে, মাটির পাত্রে রেখে বীজ সংরক্ষণ করেন”।
নারীদের এতো ধরণের অভ্যাসের কারণে আমাদের গ্রামীণ পরিবেশ এখনো টিকে আছে। আগামীতে যত ধরণের বিপর্যয় আসুক না কেন, তাঁদের চর্চা, অভ্যাস ও সৃষ্টিশীলতার কারণেই টিকে থাকবে পরিবেশ, রক্ষা হবে প্রাণবৈচিত্র্য।

happy wheels 2

Comments