বালি জমির সম্ভাবনা: বাদাম, ভূট্টা ও মিষ্টি আলু চাষের সফলতার গল্প

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডিঙ্গা একটি সীমান্তবর্তী ও পাহাড় পাদদেশীয় গ্রাম। যেখানে প্রায়ই পাহাড়ি ঢলের কারণে বালিতে জমি ঢাকা পড়ে যায়। এর ফলে অনেক উর্বর জমি অনাবাদী ও পতিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় কৃষকরা এসব জমিতে চাষাবাদ করতে না পেরে আর্থিক সংকটে পড়েন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারসিক এর সহযোগিতায় স্থানীয় কৃষকদের নেতৃত্বে বালি জমিতে পরীক্ষামূলক ১৪টি রবিশস্য ফসল চাষের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে বালি জমিতে বাদাম, ভুট্টা ও মিষ্টি আলু চাষ সফলভাবে শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে পতিত জমি আবার উৎপাদনশীল হয়ে উঠেছে এবং কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে।

সমস্যার পটভূমি
কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের অনেক জমি পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বালিতে ঢেকে যায়, যা জমির উর্বরতা নষ্ট করে এবং চাষাবাদের অনুপযোগী করে তোলে। এ কারণে কৃষকরা তাদের জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। স্থানীয় কৃষকরা জানান, আগে এসব জমিতে ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ হতো, কিন্তু বালি জমি হওয়ায় এখন তা সম্ভব হয় না।

বারসিকের উদ্যোগ ও গবেষণা
বারসিক স্থানীয় কৃষকদের সাথে নিয়ে বালি জমিতে উপযোগী ফসল চাষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করে ২০২২ সালে। গবেষণায় দেখা যায়, বাদাম, ভুট্টা ও মিষ্টি আলু বালি জমিতে ভালো ফলন হয়। বারসিক কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয় কীভাবে এসব ফসল চাষ করতে হয় এবং কিভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে মাটির উর্বরতা বাড়ানো যায়। এছাড়া, কম পানিতে চাষের পদ্ধতি এবং জৈব সার ব্যবহারের উপরও জোর দেওয়া হয়।

গবেষণার উদ্দেশ্য
গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো উপযুক্ত ফসলের জাত চিহ্নিতকরণ, পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহার, টেকসই কৃষি পদ্ধতি উন্নয়ন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকদের ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো, স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন প্রভৃতি।

কৃষকদের অভিজ্ঞতা
কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডি গ্রামে এ বছর ১২ জন কৃষক মোট ২২৪ শতাংশ জমিতে বাদাম চাষ করেছেন, ভূট্টা রোপণ করেছেন ৪ জন কৃষক মোট ৩২ শতাংশ জমিতে, মিষ্টি আলু চাষ করেছেন ৬ জন কৃষম মোট ৮৮ শতাংশ জমিতে। এ গ্রামের কৃষকরা জানান, বারসিকের গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা বালি জমিতে ফসল চাষের কৌশল শিখেছেন। এ বছর স্থানীয় কৃষক পরিমল রেমা বলেন, “আগে আমাদের জমি পতিত থাকত, ফলে কোনো আয় হতো না। এখন আমরা বাদাম, ভুট্টা ও মিষ্টি আলু চাষ করে বাড়তি আয় করছি। আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবছর আমি আরো বেশি করে বাদাম ভূট্টা ও মিষ্টি আলু চাষ করেছি। এবছর পরীক্ষামূলক ৮ শতাংশ জমিতে প্রথমবারের মত আখ চাষ করেছি।’ ” সাবিনা রেমা বলেন, “আমার আবাদী জমি বালিতে ঢাকা পড়ে যাওয়ার পর থেকে সে জমিতে কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হতো না। কিন্তু এখন বালি জমিতে বাদাম, ভূট্টা ও মিষ্টি আলু চাষ করছি। ফলনও বেশ ভালই পাচ্ছি।” সাদেক মিয়া বলেন, পাহাড়ি ঢলে আমার অনেক জমি বালুতে ঢাকা পরে যায়, এক সময় সেসব জমি অনাবাদী রাখতে হতো কিন্তু এখন বালি সহনশীল ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছি।” সুকুমার হাজং বলেন, “এ বছর আমি প্রথমবারের মত আমার অনাবাদী জমিতে বাদাম চাষ করেছি বাদাম গাছের ধরণ খুবই ভালো। আশা করি ফলনও ভালোই পাবো”।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই উদ্যোগের ফলে পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে, যা কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে। এছাড়া, স্থানীয় বাজারে ফসলের সরবরাহ বেড়েছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। নারী কৃষকরাও এই উদ্যোগে অংশ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
প্রাথমিকভাবে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা ছিল। তবে বারসিকের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে।

উপসংহার
বারসিক’র নেতৃত্বে কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামে বালি জমিতে বাদাম, ভুট্টা ও মিষ্টি আলু চাষের সফলতা এ এলাকার কৃষি খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এটি পতিত জমির ব্যবহার, কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

happy wheels 2

Comments