খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তরুণদের প্রতি কৃষিতে যুক্ত হওয়ার আহবান
মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
সম্প্রতি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার কাস্তা গ্রামে তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিংগাইর উপজেলার কাস্তা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্রের সত্ত্বাধিকারী কৃষক স্বপন রায়ের বাড়িতে জেলা প্রশাসন ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন এলাকার কৃষক কৃষাণি, কৃষি গবেষক, ছাত্র যুব, নারী পুরুষ, জেলা প্রশাসক, কৃষি উপপরিচালক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বিভিন্ন মিডিয়া ও গণমাধ্যম কর্মী, জেলা ও উপজেলা সবুজ সংহতি জেলা ও উপজেলা কমিটির প্রতিনিধি এবং বারসিক’র কেন্দ্রিয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দসহ দুই শতাধিক মানুষ।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/Lectured-by-UNO-Singair-1024x473.jpg)
তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলার মুখ্য আলোচক মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ডঃ মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে প্রতিবেশীয় কৃষি তথা জৈব কৃষি ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করানোর জন্য আমাদের এ অনুষ্ঠান আয়োজন”। এ অনুষ্ঠান আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতার জন্য তিনি বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে খাদ্য আমাদানী করে টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে মাতৃ পেশা কৃষি যুক্ত হতে হবে।”
তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত দিন ব্যাপি অনুষ্ঠান মালায় ছিলো পরিবেশবান্ধব প্রতিবেশীয় কৃষি বিষয়ক আলোচনা, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ক প্রদর্শনী, কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্রের বিভিন্ন চর্চা পরিদর্শন ও আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ এবং হাতে কলমে জৈব কৃষি চর্চার উপকরণ তৈরির প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/20250203_141004-1024x473.jpg)
তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় উঠে আসে, এক সময় গোটা বিশে^র কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিলো পরিবেশ প্রকৃতি নির্ভর ও পরিবেশ বান্ধব। ধীরে ধীরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে খাদ্যের চাহিদা। বর্ধিত জনসংখ্যার মুখে খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে কৃষিতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রাসায়নিকের ব্যবহার। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। কৃষিতে রাসয়নিকের ব্যবহার বেড়েছে ৫৪ গুণ। বক্তারা বলেন, ‘৬০ এর দশকে রাসায়নকি কৃষির যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশের কৃষিতে বেড়েছে এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাত্রা। রাসায়নিকের নেতিবাচক প্রভাব শুধু কৃষিতেই নয় বরং পরিবেশ, প্রতিবেশ ও কৃষি প্রাণবৈচিত্র্যকেও ধ্বংস করে ফেলছে।
কৃষিতে রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধির একটি তথ্যচিত্র উপস্থান করেন মানিকগঞ্জের কৃষি উপপরিচালক ডঃ রবীআহ নূর আহমেদ। তিনি বলেন, “আমরা কৃষি কাজে যে বিষ ব্যবহার করি তার ৬০% চরম বিষাক্ত। এর প্রভাব থাকে ২০-২১ দিন। এর চেয়ে অপক্ষোকৃত কম বিষাক্ত রাসয়নিক বালাইনাশকের আমদানি ৩০%। জৈব বালাইনাশক আমদানি মাত্র ১০%।” তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট ১০০টি ফসলের উপর গবেষণায় ৬৬০ জাতের পোকা শনাক্ত করতে পেরেছে। এর মধ্যে ২৩২টি অর্থাৎ ৩৮% ক্ষতিকর পোকা। ১৮৩টি উপকারী পোকা(৩০%) পরজীবি (উপকার-ক্ষতি কোনটাই করে না) ১৯২টি (৩২%)। উপকারী পোকারা সাধারণত পাতার উপরে থাকে। অপকারী পোকা পাতার নিচে থাকে। তাই বিষ প্রয়োগ করলে উপকারী পোকারাই মারা যায়।” এমতাবস্থায় তিনি জৈব কৃষির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, জৈব কৃষি করতে হলে ভালো মানের পচা গোবর ব্যবহার করতে হবে। কারণ ১০০ কেজি পচা গোবরে ইউরিয়া ৩ কেজি, টিএসপি ২ কেজি, পটাশ, থাকে ১ কেজি। গোবর মাটির পিএইচ বৃদ্ধি করে। অর্থ্যাৎ গোবর বাফার হিসাবে কাজ করে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/20250203_132504-1024x473.jpg)
তারুণ্যের উৎসব ও প্রাণবৈচিত্র্য মেলায় এলাকার কৃষক কৃষাণিরা প্রদর্শন করেন ১৫ ধরনের স্থানীয় পিঠা, ১১০ প্রকারের ধান, ডাল, তেল, মশলা ও সবজিসহ স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় বীজ, ৫০ ধরনের আপনজ¦ালা শাক ও ভেষজি উদ্ভিদ, ৪০ প্রকারের স্থানীয় বিষমুক্ত শাকসবজি, ৩০ প্রকারের কৃষি যন্ত্রপাতি। এলাকার অভিজ্ঞ কৃষক ইব্রাহিম মিয়া, মহাদেব মন্ডল, স্বপন রায়, কমলা বেগম, সেলিনা বেগম, গোসাই দাস রায়, সুভাষ মন্ডল, রেনুবালা মেলায় প্রদর্শিত উপকরনের ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিষয়ে নতুন প্রজন্মের নিকট নিজ নিজ অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন। অন্যদিকে তরুণ কৃষক শহীদুল ইসলাম, নবীন কৃষক কমলা বেগম, বেনুবালা এবং প্রবীণ কৃষক ইব্রাহিম মিয়া, মহাদেব মন্ডল হাতে কলমে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক তৈরির কৌশল উপস্থাপন করেন। যার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম জৈব কৃষি চর্চার কৌশল জানতে ও বুঝতে পেরেছেন।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসক নেতৃত্বে কৃষক স্বপন রায়ের কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্রের বীজ সংরক্ষণাগার, জৈব বালাই দমন প্রক্রিয়া, ভার্মি কম্পোস্ট, গোবর জাত সার, পুষ্টিবাগান, গরু-হাস-মুরগির খামার, অচাকৃত উদ্ভিদ প্লট, পুকুরে মাছ চাষসহ বিভিন্ন চর্চা পরিদর্শন করেন এবং আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষনের চেষ্টা করেন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীগণ।
কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক মন্তব্য করেন, “জৈব কৃষি বিষয়ে আমাদের সরকারের কোন সক্রিয় পলিসি নাই। তবে বারসিক’র মত কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ধরনের কাজগুলো করার চেষ্টা করছে। এ সংগঠনগুলোর উদ্যোশ হলো সুন্দর এবং বাসযোগ্য পৃথিবীতে আগামী প্রজন্ম যেন ভালো থাকে। সরকারের পলিসিেিত জৈব কৃষির বিষয়গুলো যুক্ত করাসহ জৈব কৃষি চর্চাকারীরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ এবং সম্মনাার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে ৮০% পোকা উপকারী ২০% ক্ষতিকর। কোম্পানির প্রলোভন ও দৌরাত্বের কারণে আমাদের উপকারী পোকা মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মাটির নিজস্ব সত্ত্বা, ধ্বংস হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য। তাই জৈব কৃষি চর্চার মাধ্যমে আমাদের কৃষিকে নিরাপদ রাখতে হবে, রক্ষা করতে হবে আমাদের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি। আর এ কাজে প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।