হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ঢেঁকি
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
সময়ের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিকায়নের ধারায় প্রতিনিয়ত মানুষের গতির পরিবর্তন হচ্ছে। কম সময়ে বেশি কাজ করার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধান ভানার কাঠের ঢেঁকিও। বর্তমান প্রজন্ম ঢেঁকি শব্দটির সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। একসময় ঢেঁকির ধান ভানার শব্দে ঘুম ভাঙত গ্রামের মানুষের, কাক ডাকা ভোরে শুরু হত ধান ভানার কাজ। ঢেঁকিতে শুধুমাত্র যে ধান ও চাল ভাঙা হত তা নয়। ধান ভানার কাজে গ্রামীণ নারীরা পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করতেন, তারা তাদের সুখ, দুঃখগুলো গ্রামীণ লোকজ গীতের মাধ্যমে সহভাগিতা করতেন। নেত্রকোনা জেলায় নগুয়া গ্রামের আলেহা আক্তার (৫০)বলেন, “ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গার কাজে ৩/৪জন সাহায্যকারী থাকতো। ধান ভানার কাজটি অনেক কায়িক পরিশ্রমের হলেও গ্রামীণ নারীদের কাছে পরিশ্রমের বলে মনে হত না বরং তা ছিল আনন্দের কাজ”।
যন্ত্রনির্ভর এযুগেও নগুয়া গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এখনও কাঠের ঢেঁকির ব্যবহার দেখা যায়, যা অন্য এলাকায় দেখা যায় না। গ্রামের নারীরা এখনও পিঠার জন্য চালের গুড়ি তৈরি, কোন সময় ঘরে চাল না থাকলে অল্প পরিমাণে ধান ভেঙে চাল করতে ঢেঁকির ব্যবহার করে থাকেন। সব ধরনের পিঠা যেমন- পুলি পিঠা, তেলের পিঠা, মইল, ধামা, ভাপা পিঠা ইত্যাদি মেশিনে ভানা চালের গুড়া দিয়ে ভালো হয় না। তাছাড়া বড় ধরনের অনুষ্ঠান যেমন-বিয়ে, মেহমানি, হাইট্টারা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মসলা গুড়ো (মরিচ, হলুদ, জিরা, আদা, গুয়ামুড়ি) করার ক্ষেত্রেও ঢেঁকির ব্যবহার করতে দেখা যায়।
ঢেঁকি তৈরিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গাব কাঠ, বদ্ধিরাজ, বেল কাঠ, কাঁঠাল গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে গাব গাছ, বদ্ধিরাজ ও বেল গাছ কমে যাওয়ায় ঢেঁকি তৈরি ও এর ব্যবহার আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। একটি ঢেঁকি প্রায় কয়েক দশক ব্যবহার করা যায়, শুধুমাত্র কালিটি (মৌনি/উচা) কয়েকবছর পর পর পরিবর্তন করলেই হয়। অন্যদিকে গ্রামীণ মানুষ ধান ভানার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও যন্ত্রনির্ভর হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মূখীন হচ্ছে। যান্ত্রিক উপায়ে ধান, পিঠার গুড়ি ও মসলা ভানার জন্য চেয়ে থাকতে হচ্ছে বিদ্যুৎ জ্বালানির উপর। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের লোডশেডিং এর ফলে ধান ভানার জন্য গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। যেখানে ঢেঁকিতে ধান ভানার জন্য মানুষকে কায়িক শ্রম ছাড়া অন্য কোন জ্বালানির প্রয়োজন হত না, সেখানে বর্তমান যুগে প্রয়োজন হচ্ছে বিদ্যুত ও কেরোসিন/ডিজেল জ্বালানির। ঢেঁকিতে শব্দ দূষণ মেশিনের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম হত, মেশিনে মানুষের কায়িক তেমন কোন পরিশ্রম হয় না। কায়িক শ্রম কমে যাওয়ায় গ্রামীণ মানুষ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মূখীন হচ্ছে। লোপ পাচ্ছে ঢেঁকিতে ধান ভানার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক বন্ধন।
নগুয়া গ্রামের আলেহা আক্তার বলেন,“ঢেঁকি চাটা চাল খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। এখন ডাক্তাররা আমাদের এ চালের ভাত খাওয়ার পারামর্শ দেন। আমি বাচ্চাদের জন্য ঘরের খাবার তৈরি, মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য পিঠা তৈরি করতে ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করি। ঢেঁকি চাটা চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পিঠা অনেক সুস্বাদ হয়। নিজেদের ইচ্ছে মত প্রয়োজনের সময় আমরা ঢেঁকিতে চাল ও পিঠার গুঁড়ো ভানতে পারি”।
স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা, গ্রামীণ মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, আন্তঃনির্ভরশীলতা, সুখ-দুঃখের কথা সহভাগিতায় ঢেঁকির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই আমাদের গ্রামীণ সমাজে ধান ও পিঠার গুঁড়ি ভানায় প্রয়োজন মেশিন নির্ভরশীলতা হ্রাস করে গ্রামীণ প্রযুক্তি ঢেঁকির প্রচলন করা এবং বিলুপ্তির হাত থেকে ঢেঁকিকে রক্ষা করা।