প্রসঙ্গ: জলবায়ু পরিবর্তন এবং লস এন্ড ড্যামেজ
ঢাকা থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম
১.
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দীর্ঘদিন আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বেশি আলোচিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার আগে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো আলোচনা করা জরুরি। জলবায়ু বায়ু পরিবর্তন একটি চলমান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি ইতিমধ্যে উষ্ণ ও বরফ যুগ অতিক্রান্ত করে এখন তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করছে। কিন্তু এই চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি সামঞ্জস্যতা ছিল। কিন্তু আঠারো শতকের পর উন্নত দেশের অতিমাত্রায় শিল্পায়ন ও ভোগ বিলাসী জীবনযাপন এবং তথাকথিত কৃষির আধুনিকায়নের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটতে থাকে এবং যা আমাদের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর বিরূপ প্রভাব্ বিস্তার করতে থাকে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৮০০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি যা ১৯১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ ডিগ্রিতে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে এ প্রভাব পড়ছে বৃষ্টিপাত, জনস্বাস্থ্য, প্রাণবৈচিত্র্য, জীবন ও জীবিকা তথা সামগ্রিক ব্যবস্থার উপর।
২.
‘লস এন্ড ড্যামেজ’কে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট যে কোন একটি দূর্যোগের সর্বশেষ ধাপ বলা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে টিকে থাকার জন্য আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোর অভিযোজন করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কিন্তু অভিযোজন পদ্ধতি দ্বারা যখন দূর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলা করা না যায় তখনই লস এন্ড ড্যামেজ বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় এবং তখনই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সবার সামনে উঠে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো ও প্রাণবৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এই ক্ষতিগুলোকে মাত্রাভেদে ‘লস এবং ড্যামেজ’ বলা হয়। লস এবং ড্যামেজের কার্যকর সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। তারপরও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এর একটি সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ড্যামেজ হলো দূর্যোগের ফলে সৃষ্ট সেই অবস্থা যেখান থেকে ধীরে ধীরে আবার আগের অবস্থার কাছাকাছি ফিরে আসা যায়। যেমন বনভুমি ক্ষতি, ফসল নষ্ট, বাড়িঘর নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বোঝায়। কিন্তু লস বা ক্ষতি হলো দূর্যোগের ফলে সৃষ্ট সেই অবস্থা যা আর কখনই পূরণ করা সম্ভব নয় বা আগের অবস্থায় আসা সম্ভব নয়। যেমন, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর উপর যে প্রভাব সৃষ্টি হয় তা বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে একটি হলে “আবহাওয়ার আকস্মিক ঘটনা (Extreme weather Events)”এবং অন্যটি হলো” জলবায়ুর ধীরগতির মাধ্যমে সংঘটিত ঘটনাসমূহ (Slow onset events)”এবং উভয় ঘটনাসমূহ একে অপরের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। আবহাওয়ায়র আকস্মিক চুড়ান্ত ঘটনাসমূহ (Extreme weather Events) হলো-খরা, বন্যা, ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, তাপপ্রবাহ ইত্যাদি। এই ঘটনাগুলো যেকোন সময় হয়ে থাকে বলে একে আবহাওয়ার আকস্মিক ঘটনা বলা হয়। যেমন: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সাইক্লোন আইলা, সিডর, মহাসেন, হাওরের হঠাৎ বন্যা ও উত্তরাঞ্চলের আকস্মিক বন্যা এবং বাঙ্গামাটিসহ অন্যান্য এলাকার পাহাড় ধ্বসের ফলে সৃষ্ট দূর্যোগ ইত্যাদিকে আবহাওয়ার আকস্মিক দূর্ঘটনা বলা হয়। জলবায়ুর ধীরগতির মাধ্যমে সংঘটিত (Slow onset events) ঘটনাসমূহ হলো-মরুময়তা, প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতি, মাটি এবং বনভুমি ক্ষয়, হিমবাহ স্থানচ্যুতি ও ক্ষয়, সামদ্রিক অম্লতা বৃদ্ধি, সমুৃদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, বায়ু মন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এই গুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়। যেমন: বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমুৃদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বরেন্দ্র এলাকায় শুরু হওয়া মরুময়তা ইত্যাদিকে জলবায়ুর ধীরগতির মাধ্যমে সংঘটিত ঘটনা বলা হচ্ছে।
৩.
‘লস এবং ড্যামেজ’ নিয়ে স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয় অনেক আগে থেকে। একটি হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ১৯২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। সিডরের পর থেকেই বাংলাদেশ ২০০৭ সালে ‘লস এন্ড ড্যামেজ’-এর ক্ষতিপূরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব করে কিন্তু এই ‘লস এবং ড্যামেজ’ নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সুস্পষ্ট গাইডলাইন না থাকায় এটা নিয়ে কোন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো যারা প্রাকৃতিক অন্যান্য দূর্যোগের পাশাপাশি সমুৃদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত মূল ভূখন্ড হারাচ্ছে তারা তাদের ‘লস এবং ড্যামেজ’ এর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক বীমা পুল এর নিকট আবেদন করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতিকে বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করা হয় কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতির বাইরেও অনেক ধরনের ক্ষতি হয়ে থাকে। যেমন জনস্বাস্থ্য, চলাচল সমস্যা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও লোকায়ত জ্ঞান ও দক্ষতা এবং প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতি বের করার কোন পদ্ধতি এখনও না থাকায় এই ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ও নিস্পাপ ভিকটিম হওয়ার কারণে স্বল্প উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অকর্ষণ করে কপ-১১ (COP-11) তে ‘লস এবং ড্যামেজ’ এর ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য উন্নত দেশের নিকট প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবনার পর থেকে ‘লস এবং ড্যামেজ’ এর ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। পোল্যান্ডের ওয়ারসতে অনুষ্ঠিত কপ-১৯ ‘লস এবং ড্যামেজ’ এর ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয় যাদের কাজ ছিল ক্ষতি পূরণ দেওয়ার জন্য একটি গাইডলাইন বের করা। আন্তর্জাতিক নেগোশিয়েশনে এই ইস্যুটি এখন একটি ভালো অবস্থায় রয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে বার্লিনে অনুষ্ঠিত আগামী কপ-২৪ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করা যাবে।
৪.
জলবায়ু বিজ্ঞানীদের অভিমত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে শুধু গ্রীণল্যান্ডের বরফ গলে গেলে বাংলাদেশে সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা তিন মিটার বেড়ে যাবে, ডুবে যাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলা। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা করা বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রতিদিনের সংগ্রামের নাম। অভিযোজনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকি কমানোর পথ হলো অন্য পার্টির কাছে ঝুঁকি বিনিময় করা। এই ঝুঁকি বিনিময় করার জন্য দরকার আইন কাঠামো তৈরি, চুক্তি, বীমা বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কার্যকর করা যেটার মাধ্যমে এই ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। এই ঝুঁকি বিনিময় করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে জীবন বীমা, শস্য বীমা, লাইভস্টক বীমা করার মাধ্যমে ঝুঁকিকে কমানো যেতে পারে। এটা কার্যকর করা উপায় হলো উন্নতদেশের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা। আন্তর্জাতিকভাবে যে গ্রীণ ক্লাইমেন্ট ফান্ড রয়েছে সেখানে এই বীমা খরচ সংযুক্ত করে এটাকে একটি আইনি কাঠামোর মাধ্যমে কার্যকর করা যেতে পারে। এই বীমা কার্যকর করা গেলে দূর্যোগ ঝুঁকি হাসের মাধ্যমে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি, দ্বীপ রাস্ট্র এবং দরিদ্র দেশগুলোর জলবায়ু দূর্গত মানুষগুলো কিছুটা হলেও সুবিচার পাবেন। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য স্থানীয় পর্যায় থেকে সচেতনতার কাজ শুরু করা দরকার। যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথাগুলো বাংলাদেশের আইন প্রণেতাদের কাছে পৌঁছানো যায়। আর আমাদের আইন প্রণেতারা যাতে এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে দরকষাকষি করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন।