মানিকগঞ্জের প্রাচীন নিদর্শনগুলো
গোটা দেশে যে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটি জমিদার বাড়ি অন্যতম। জমিদারির স্থায়িত্বকাল ১৭৯৩-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এ বাড়িতে ঢুকেই কারুকাজ দেখে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়িটির বয়স ৩০০ বছর ছাড়িয়েছে। তেওতা জমিদার বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে- আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার প্রিয়তমা প্রমীলা দেবীর প্রেমের স্মৃতি। এ জমিদার বাড়িতেই প্রমীলা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি বলে উঠেছিলেন, “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ”—- কালের কীর্তিমান সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মানিকগঞ্জের এই দুই জমিদার বাড়ি নিয়ে লিখেছেন, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি আব্দুর রাজ্জাক।
নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিময় তেওতা জমিদার বাড়ি
তেওতা জমিদার বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে- আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার প্রিয়তমা প্রমীলা দেবীর প্রেমের স্মৃতি। জমিদার বাড়ির পাশেই ছিল নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীর বাড়ি। প্রমীলা দেবীর পিতা বসন্ত সেনের ভ্রাতুষপুত্র বীরেন সেনের সঙ্গে কবির পরিচয় সুত্র ধরে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়িটির বয়স ৩০০ বছর ছাড়িয়েছে। জেলার ইতিহাস থেকে জানা গেছে, সপ্তদশ শতকের শুরুতে পাঁচুসেন নামের পিতৃহীন দরিদ্র এক কিশোর তার সততা আর চেষ্টায় তামাকের ব্যবসা করে বিপুল ধন সম্পদ অর্জন করেন। দরিদ্র পাঁচুসেন দিনাজপুরের জয়গঞ্জে জমিদারি কিনে হয়ে যান পঞ্চানন সেন। তারপর শিবালয়ের তেওতায় তিনি এই জমিদার বাড়িটি তৈরি করেন। জমিদার বাড়ির মূল ভবনের উত্তর দিকের ভবনগুলো নিয়ে হেমশংকর এস্টেট এবং দক্ষিণ দিকের ভবনগুলো নিয়েছিল জয়শংকর এস্টেট। প্রতিটি এস্টেটের সামনে বর্গাকৃতির অট্টালিকার মাঝখানে আছে নাটমন্দির। পুর্বদিকের লালদিঘী বাড়িটি ছিল জমিদারদের অন্দর মহল। অন্দর মহলের সামনে দুটি শানবাঁধানো ঘাটলা, এর দক্ষিণ পাশের ভবনের নীচে রয়েছে চোরা কুঠুরী যাকে এলাকার মানুষেরা বলে অন্ধকুপ। উত্তর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৪ তলা বিশিষ্ট ৭৫ ফুট উচ্চতার নবরতœ মঠ। এর ১ম ও ২য় তলার চারদিকে আছে ৪টি মঠ। তেওতা জমিদার বাড়িটি ৭.৩৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।
এই জমিদার বাড়িটি নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য একটি স্থান। এখানে নজরুলের বেশ কিছু স্মৃতি খুঁজে পাওয়া গেছে। বাড়িটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসেন। বাড়িটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পযটন আসে আরিচার শিবালয়ের তেওতায়। ঢাকা থেকে আরিচার দূরত্ব ৯০ কিঃ মিঃ। ৩ ঘণ্টায় বাসে যেতে ভাড়া দিতে হবে ৮০-১০০ টাকা। গাবতলী থেকে যাত্রীসেবা, বিআরটিসি, পদ্মা লাইন ইত্যাদি বাসে আরিচা ঘাট যেতে হবে। আরিচা ঘাট থেকে অটো/রিকশায় ২০/৩০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যাবে তেওতা জমিদার বাড়ি।
কালের কীর্তিমান সাক্ষী সাটুরিয়ার “বালিয়াটি জমিদার বাড়ি”
গোটা দেশে যে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটী জমিদার বাড়ি অন্যতম। জমিদার বাড়ি যা ”বালিয়াটী প্যালেস” নামে কালের কীর্তিমান সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। শত বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িটি বছর কয়েক আগেও জিন-ভুতের আড্ডা খানা ভাবতো এলাকাবাসী। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে ব্যাপক সংষ্কার করা হয়। প্রত্নতত্ব বিভাগের ছোয়ায় এখন তা নতুন সাঝে সজ্জিত হয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে। দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এ বড়িতে ঢুকেই কারুকাজ দেখে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। ভূয়সী প্রশংসা করেন সে আমলের নির্মাণ কারিগরদের।
জানা গেছে, এই দালানগুলো মধ্য ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতকের প্রথমভাগের বিভিন্ন সময়ে একটি ধনী পরিবারের কয়েকজন সদস্যের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন গোবিন্দ রাম সাহা। তিনি মূলত আঠারো শতকের শেষ দিকে একজন বর্ধিষ্ণু লবণ ব্যবসায়ী ছিলেন। গোবিন্দ রাম সাহার পরিবারের জমিদারির স্থায়িত্বকাল ১৭৯৩-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৫৭ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগেই জমিদারগণ এ বিশাল প্রাসাদ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। তাদের জমিদারী ২ভাগে বিভক্ত ছিল যা দশ’আনি আর ছ’আনি অংশ নামে পরিচিত। দশ’আনি অংশের জমিদারবাড়ি বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ব বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে রয়েছে ৪টি বৃহদাকার সুদর্শন অট্টালিকা। প্রত্যেক অট্টালিকায় ঢুকার জন্য রয়েছে ভিন্ন চারটি ভিন্ন প্রবেশ দ্বার। প্রত্যেকটি দ্বারের ওপরে রয়েছে একটি করে সিংহ মূর্তি যা দেখলে জ্যান্ত মনে করে পর্যটকরা বিশেষ করে শিশুরা আতকে উঠে। চারদিকে সিমানা প্রাচীর ঘেরা প্রায় ২০ একর বাড়িটির ভিতরে আরও ৩টি ভবন রয়েছে। প্রত্যেক ভবনের ছাদে উঠার জন্য রয়েছে শাল আর সেগুন কাঠ দিয়ে বিশাল ব্যয়ে নির্মিত সিঁড়ি।
প্রাসাদের অট্রালিকা তিনতলা বিশিষ্ট হলেও উচ্চতায় বর্তমান সময়ের পাঁচ তলা ভবনের সমান। সামনের চারটি ভবনের দ্বিতীয় ভবনে রয়েছে তাদের নির্মিত প্রমোদগার বা রংমহল। জমিদারদের ওই সময়ে ব্যবহৃত আসবাবপত্র দিয়ে এ কক্ষটি এখনো সাজানো রয়েছে। পর্যটকরা দেখেন অবাক বিষ্ময়ে। সাতটি ভবনের মধ্যে চারটি ছাড়া বাকী ভবনগুলো বসবাসের অনুপযোগী। বাড়ির ভিতরে রয়েছে মনোরম পরিবেশে আম, কাঠাল, বেল, লিচ, জাম্বুরা গাছসহ হরেক রকম ফল আর ফুলের গাছ।
দেশী ও বিদেশী পর্যটকের ভীড় নিত্য দিনের ব্যপার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, শিল্প কারখানার মালিক কর্মচারী এমনকি গার্মেন্টস কর্মীরাও দলবেধে পিকনিক করতে আসেন। জমিদার বাড়ির মুল ফটকের আঙিনা ঘেষে গড়ে উঠেছে বেশকিছু হোটেল-রেস্তোরা। বালিয়াটী প্রাসাদে ভ্রমনে এলে দর্শনার্থীরা প্রসংশা করে গাভীর দুধের তৈরি বিখ্যাত ”ছানা সন্দেস” খেয়ে। এছাড়াও প্রাসাদের ফটকের বাইওে বসে হরেক রকম মুখরোচক খাবার ও প্রসাধনীর পসরা।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জের গর্ব আখ্যায়িত করে সাটুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন ঠান্ডু জানান, ইতোমধ্যে সরকার বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ব্যাপক সংষ্কার করে আধুনিকায়নের কাজ করেছে। এমনকি প্যালেজে যাওয়ার রাস্তা ঘাটেরও ব্যপক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে স্বল্প মূল্যের টিকেট ব্যবস্থায় দর্শনার্থীদের প্রবেশের ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও হচ্ছে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কালামপুর বা গোলড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে মনোরম পরিবেশে এ প্রাসাদের অবস্থান। ঢাকার গাবতলী থেকে সাটুরিয়া যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৬০-৭০ টাকা। সাটুরিয়া পৌঁছে সেখান থেকে রিকশা বা লোকাল সিএনজিতে করে জমিদার বাড়ি যাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া ১০টাকা। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি রোববার পূর্ণদিবস আর সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও বন্ধ থাকে। জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ১০টাকা।