পশু ও পাখি ভালোবেসে রাশেদের ছুটে চলা
সাতক্ষীরা থেকে এস. এম. নাহিদ হাসান
ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পশু ও পাখি তার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু তার এ ভালো লাগার ওপর যখন আঘাত আসতো তখন তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না। তার বন্ধুরা শালিক, ঘুঘু, বিড়াল, কাঠবিড়ালি মেরে খুব আনন্দ করতো তখন তার মনটা বলতো আমি যদি এ প্রাণিদেরকে মুক্ত করতে পারতাম! কখনো সখনো সুযোগ পেলে প্রাণিগুলো বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়ে ছেড়েও দিতেন। মনে মনে ভাবতেন মানুষের মত এসব প্রাণিরও তো জীবন আছে। তাহলে কেন এভাবে এ প্রাণিদের কষ্ট পেতে হবে? তখন থেকেই তার এই সব প্রাণিদের প্রতি মায়া কাজ করা শুরু করলো। বাড়ির আশেপাশে যখনই পশুপাখির উপর নির্যাতনের খবর আসতো ছুটে যেতেন রক্ষা করতে। কখনো রক্ষা করতে পারতেন আবার কখনো মন খারাপ করে ঘরে ফিরতেন।
তালা শহীদ কামেল মডেল হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করার পর ২০০৭ সালে খুলনা সরকারি বি. এল. কলেজে ইংরেজিতে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হন। মেসে থেকে শুরু হয় তার লেখাপড়া। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি দৌলতপুরের মোহনা সাহিত্য সমাজ কল্যাণ সংগঠনে কবিতার আসরে বসতেন। লেখাপড়ার অবসরে যখন ছুটিতে বাড়ি আসতেন তখন এলাকায় ঘুরে মানুষদের পাখি সংরক্ষণের জন্য সচেতন করার চেষ্টা করতেন। প্রথম আলো পত্রিকার সাপ্তাহিকী ‘ছুটির দিন’ মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। সেখানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে লেখালেখি করতেন। বিশেষ করে শরিফ খান, সৈারভ মাহমুদ, আ. ন. ম আমিনুর রহমান স্যারদের লেখা নিয়মিত পড়তেন। সেগুলোর পেপার কাটিং এখনও সংরক্ষণ করে রেখেছেন। স্যারদের এই লেখাগুলো পড়ে ভাবতেন শুধু আমি না দেশের বড় বড় মানুষরাও এই বিষয় নিয়ে ভাবেন। আমি যে বিষয় নিয়ে ভাবি এবং মানুষের সচেতন করি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন থেকে তিনি অধিক উৎসাহ নিয়ে লেগে গেলেন প্রকৃতির ভারসাম্য বহনকারী এই প্রাণিগুলোকে রক্ষা করতে। মোহনা সাহিত্য সমাজ কল্যাণ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকায় কারণে বাংলাদেশ পাখি ও বন্যপ্রাণি বিশ্লেষক শরিফ খানের সাথে ফোনের মাধ্যমে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। শরিফ খান তাকে অভিন্দন জানান এবং এ বিষয় নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা দেন। তখন থেকে তিনি শরিফ খানের কাছ থেকে বন্য প্রাণি, পাখি সংরক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত পরামর্শ নেন। বর্তমানে তিনি পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। আর নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন তালা সদর ইউনিয়নের আগোলঝাড়া গ্রামের মানুষের কাছে প্রকৃতির বন্ধু হিসাবে পরিচিত একজন তরুণ শিক্ষক রাশেদ বিশ্বাস। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার বন্য প্রাণি ও পাখিদের নিয়মিত খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন জেলা, উপজেলাসহ যে সকল এলাকা বা বিলে পাখির আনাগোনা সে এলাকার মানুষদের সচেতন করে যাচ্ছেন। শীতকালে বেশ কিছু এলাকায় অতিথি পাখি আসে আর তখনই শিকারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। যখনই তিনি খবর পান কোথাও পাখি শিকার হচ্ছে অথবা পাখি ও বন্য প্রাণির আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে তখনই তিনি সেখানে ছুটে যান এবং শিকারিদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন। একই সাথে শিকারিদের বোঝান যে আমাদের জলবায়ুর জন্য পাখি কতটা দরকার। এই প্রাণিরা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝে শিকারীদের শপথ পাঠ করান।
এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এখন তাকে নিয়ে বেশ গুঞ্জন চলে। প্রথম প্রথম তার কাজকে পাগলের পাগলামি বলে উপহাস করতো। কিন্তু তিনি হতাশ হননি, কাজ বন্ধ রাখেন নি। এখন সবাই তার কাজকে সাদরে গ্রহণ করছে। এলাকায় তিনি এখন পাখি প্রেমী রাশেদ হিসাবে পরিচিত। তার কাজে প্রথম থেকে সাহস দিয়েছেন তার বন্ধু ইমরান হোসেন ও ছোট ভাই সোহাগ হোসেন। বর্তমানে তার কার্যক্রম বিস্তার লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষও বেশ সহযোগিতা করছেন। তার নিজ তালা উপজেলাসহ আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলায় বন্যপ্রাণি, পাখি সংরক্ষণ ও বিচরণ ক্ষেত্র উম্মুক্ত রাখতে সকলকে আহবান জানিয়ে আসছেন। তালার পাখিমারার বিল, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রাম, ডুমুরিয়ার বিলসহ বেশ কিছু এলাকায় তিনি সম্প্রতি পাখি নিধন বন্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন।
যারা শখের বশে এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করে তাদের রুখতে ছাত্র, যুবকদের সচেতনামূলক লিফলেট বিতরণ করছেন। এছাড়াও প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে বিভিন্ন ভাবে সহযোতিার মাধমে পাখি শিকারকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন। তার এ কাজের জন্য তালা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ হাসান হাফিজুর রহমানের সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছেন। বিভিন্ন সময় পুলিশ পাঠিয়ে পাখি শিকারিদের আইনের আওতায় এনেছেন। তার এ কাজে সাধারণ মানুষের সাধুবাদ পেলেও ধীরে ধীরে রাশেদ বিশ্বাস পাখি শিকারিদের পথের কাঁটা হয়েছেন। বিভিন্নভাবে তাকে এ কাজ বন্ধ করার জন্য বলা হলেও তিনি থেমে থাকছেন না। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও মানুষের সহযোগিতায় তিনি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পাখি শিকার বন্ধে প্রচরণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাশেদ বিশ্বাসের কাছে তার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, “আমার নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এ কাজ করি। আমি যখন এ কাজ শুরু করি তখন আমার বাড়ির লোকই আমার এ কাজ বন্ধ করতে বলেছিলো; কিন্তু আমি আমার কাজ বন্ধ করিনি। আমি বিশ্বাস করি নির্বিচারে পশুপাখি হত্যা করে আমরা আমাদের এই পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারবো না।” তিনি আরো বলেন, “আমি যখন শিকারিদের কাছ থেকে পাখি উদ্ধার করে মুক্ত করতে পারি তখন মনে হয় আমার কাজ সার্থক। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ গুলো রক্ষা করা একান্ত জরুরি।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের সমাজের ২ শ্রেণির মানুষ পাখি বা বন্য প্রাণি শিকার করে। এক শ্রেণির মানুষ যারা দরিদ্র তারা সামান্য অর্থের জন্য এ কাজগুলো করে থাকে। তারা পাখি প্রতি ৫০-৪০০ টাকা আয় করে থাকে। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হই তা এ শ্রেণির মানুষেরা বোঝে না। আর অন্য শ্রেণীর মানুষ তারা শুধুমাত্র শখের বশে পাখি শিকার করে থাকে। এগুলো আসলে একদিনে বন্ধ করা সম্ভব না। দিন যত যাচ্ছে অভিনব কায়দায় পাখি শিকার করা হচ্ছে। এয়ারগান, ফাঁদ পেতে, বিলে মাছে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে, শব্দ ফাঁদ, কারেন্ট জাল ব্যবহার করে শিকারিরা তাদের কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি করা। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, “আমি আগামীতে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনাতমূলক ক্যাম্পেইন ও এয়ারগানধারীদের তালিকা প্রশাসন ও জনগণের কাছে পৌঁছে দেবো।” তিনি আরো বলেন, “ আমাদের বন্য প্রাণি সংরক্ষণের যে আইন আছে তার সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমরা কিছুটা হলেও আমাদের এই পাখিগুলোকে বাঁচাতে পারবো। একই সাথে আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে আর অন্যদের সচেতন করতে হবে।”