ভাঙছে ইছামতী ভূ-খন্ড হারাচ্ছে বাংলাদেশ
সাতক্ষীরা থেকে মীর খায়রুল আলম
সাতক্ষীরা জেলার গাঁ ঘেঁষে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। যেটি বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সীমানা বেয়ে চলেছে। জেলার কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালিগঞ্জ উপজেলার সীমানা দিয়ে বহমান ইছামতী।
জেলার কয়েকটি বহমান নদীর মধ্যে অন্যতম বহমান নদী ইছামতী। আর এই ইছামতী নদীর বড় একটি অংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে দেবহাটা উপজেলা। দেবহাটা উপজেলার সীমানা বয়ে চলা প্রবাহিত ইছামতী নদী বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হয়ে সর্বনাশা রূপ ধারণ করছে। তার হিংস্র থাবায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদী গর্ভে। প্রতিবছর ইছামতীতে দেখা দেয় তীব্র ফাটল ও ভাঙন। ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় লাখ টাকার। বেড়ে যায় অপ্রত্যাশিত ভোগান্তি।
নদী ভাঙনের কারণ খুঁজতে উঠে আসে অবৈধ বালু কাটা, জাল ঠেলা, অবৈধভাবে নদীর পাড় ঘিরে নিয়ে ইচ্ছামত ছোট-বড় ঘের তৈরি, বেড়ি বাধ কেটে পাইপ ঢুকিয়ে পানির উত্তোলনকে প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হল ইজারাকৃত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা। দেবহাটা সীমান্ত ইছামতীর পাড়ের গ্রামগুলোর জনসাধারণ প্রতিনিয়ত উদ্বেগ আর আতঙ্কর মধ্য দিন অতিবাহিত করে।
দেবহাটা সীমান্ত সংলগ্ন খানজিয়া, নাংলা, নওয়াপাড়া, ছুটিপুর, বসন্তপুর, উপজেলা সদর, বিওপি সংলগ্ন ও থানা ভবন, খাঁপাড়া, শীবনগর, সুশীলগাঁতী, চর-শ্রীপুর, ভাতশালা, কোমরপুর, হাড়দ্দাহসহ বিভিন্ন গ্রামের জন সাধারণের দিন কাটে দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে। ভাবনায় মনেদোলা দেয় কখন বেড়ি টপকিয়ে, ভেঙ্গে বা ধ্বসে পানি প্রবেশ করে। মনে পড়ে যায় ২০০৯ সালে সেই ভয়াবহ বন্যার কথা। যেটি ঘটেছিল থানা ভবন হতে কয়েক গজ দুরে সুশীলগাঁতী নামক স্থানে। বেড়ির তীব্র ফাটল ও ভাঙনে ইছামতী নদীর পানির চাপে ৫-৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ফসলি জমির ধান, মৎস্য ঘের, বসত বাড়ির খামার, আঙ্গিনা ডুবে যায়। এমনকি প্রাণহানির আশংঙ্খা দেখা দিয়েছিল। এতে ব্যাপকভাবে স্থানীয় বাসী ক্ষতির মুখে পড়ে। তৎকালীন হুমকিতে থাকা এলাকার মানুষের অনেকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। সাময়িকভাবে ভেড়ি বাঁধ রক্ষা পেলেও দিন কয়েক পর আবারো নতুন ভেড়ির ধ্বংস নামতে থাকে। কোন রকম জোড়া তালি দিয়ে কেটে যায় বর্ষার মৌসুম। ফের বছরগুলো পার করতে আবারো ছোট বড় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এরপর ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে এসে আগের ভেড়িতে ভাঙন ধরাতে মারাত্মক রূপ নেয়।
তবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অদুরদর্শীতা ও অব্যাবস্থাপনার কারণে ভেড়ি সংস্কারে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সে সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আ.ফ.ম রুহুল হক, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, জেলা পরিষদ প্রশাসক মুনসুর আহমেদ, ৩৮ বিজিবি ব্যাটলিয়ান অধিনায়ক লেঃ কর্নেল ইমাম আহছান, পাত্তবো কর্মকর্তা আঃ হান্নান খাঁন, দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম তরিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনে জানানো হয় নদীর বাঁধ রক্ষায় নতুন বেড়ি দেওয়া হবে এবং নদী ভাঙন রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসময় প্রায় ৫০০ শতাধীক বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধ করা হয়।
এদিকে সুশীলগাঁতীর বাধ রক্ষার্থে শিবনগর এলাকায় তৈরি করা হয় ম্যানগ্রোভ বন। যা পরিবেশের ভারসাম্য ও বাঁধ রক্ষায় কাজ করবে। দিন যেতে যেতে বনের পরিধি, আকার ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করতে বহু দূর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কোন রকমে শেষ করা হয় বনের কাজ। কিন্তু ভাঙতে থাকে নতুন-পুরাতন বেড়ির বাঁধ। ২০১৪ সালে পুনরায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এরপরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া শেষ হয়নি। কিন্তু তখনও থেমে ছিল না অবৈধ বালু কাটা, জাল ঠেলার কাজ। ২০১৫ সালে এসে আবারো দেখা দিয়েছে পূর্বের নতুন ভেড়ি ও পুরাতন ভেড়ির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবাহ ফাটল।
এরপর ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত দেবহাটার কোমরপুর, ভাতশালা, নাংলাসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিলে সে সব স্থানে স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এতে অনেক সংশয় আর হতাশায় দিন পার করছে সীমান্ত পাড়ের মানুষ। সীমান্ত পাড়ের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় ইতোপূর্বে ইছামতী প্রতিনিয়ত ভাঙছে তো ভাঙছে। ভূ-খন্ড রক্ষা করতে অবিলম্বে স্থায়ী সমাধান অপরিহার্য। বাংলাদেশ-ভারত বিভক্তকরণ খরস্রোত ইছামতী ভাঙন রোধ না করতে পারলে দেবহাটার মানচিত্র ছোট হয়ে আসবে এবং বাংলার ভূ-খন্ড হারাবে।