গ্রামীণ লোক ঐতিহ্য: জোঁভাতি বা টোপাভাতি খেলা

মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম:
মানবজীবন কতই না বৈচিত্র্যে ভরপুর। পিতার পেরেশানি ও মাতার জরায়ুর কান্না ভেঙে অবশেষে স্থান হয় মাতৃগর্ভে। শিশু কান্নাকাটি করেই মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে সুজলা সুফলা রঙ বিরঙের এই দুনিয়াতে। শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার মা-বাবা ও পরিবারের সাথে নলা-কলা, ছলা খেলায় বেশ আনন্দে দিন কাটার মধ্য দিয়েই কৈশোরে পদার্পন করে। তারপর তার আকাঙ্খা বাড়তে থাকে এবং বাইরের দুনিয়ার খেলার সাথীদের সাথে নানান রঙের খেলাধুলা করতে সে আরো আনন্দ খুঁজে বেড়ায়।
খেলার জগতে এখনো সবকিছু একেবারে হারিয়ে যায়নি, তবে যাওয়ার পথে। শিশু-কিশোরকালের হাজার বছরের গ্রামীণ লোকায়ত ঐতিহ্য বাড়ির আশেপাশের পাড়ায় শিশু কিশোরদের নিজ হাতে রান্না বান্নাভিত্তিক জোলাপাতি/টোপাভাতি/জোলাভাতি ইত্যাদি নামের খেলা একসময় বেশ প্রচলিত ছিলো। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অঞ্চলভেদে ভিন্নভিন্ন নামে এই খেলা থাকতে পারে। আমাদের মানিকগঞ্জর মানুষ এই খেলাকে ’জোলাভাতি’ খেলা নামেই বেশি চিনে। জেলার ও বিভিন্ন এলাকায়’ টোপাভাতি’সহ ভিন্ননামেও ডাকতে পারে।
বর্তমান বৈশি^ক পূঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ও বিজ্ঞানের আড়ালে চরম ধর্মান্ধতায় সমাজের শিশু-কিশোরদেরকেও প্রযুক্তি দিয়ে ঘরের মধ্যে ব›ীদ করে রাখা হয়েছে। আধুনিকতার নামে লোকয়াত চর্চাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে।
প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ জায়গা থেকে একটু ফিরে তাকালে দেখতে পাব যে, আমাদেরও শৈশব ও কৈশোরকাল ছিলো তবে আমরা সেগুলো ভুলতে বসেছি। আমাদেরও ছোটবেলায় ঘরে বাইরে যেসব উপকরণ প্রয়োজন তার উপলদ্ধি আসে এই খেলার মাধ্যমে। শিশু কিশোরদেও কাছে জোলাভাতি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম। এই খেলায় ছেলেমেয়ে মিলেমিশে একসাথেই খেলে। জীবন অধ্যায়ের অন্যতম পাঠশালা বলা হয় এই খেলাকে। শিশু কিশোরদের এই ছেলেমি/দুষ্টমী খেলা অবিভাবকদের হাসির খোড়াক যোগায়। অনেকসময় তারা মুখ টিপে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। কল্পনায় তারা চলে যান অনেক দূর এবং স্বপ্ন বুনেন এই দুষ্টদের নিয়ে তারাই একদিন বড় মানুষ হবে। খেলার মাধ্যমে একজন মেয়ে শিশু বউ ও একজন ছেলে শিশু জামাই সেঁজে তারা যে মেকি সংসার পেতে রান্নাবান্না করে সবাইকে খাওয়ার জন্য আহবান করে ও পাতায় বৈঠক দেয় এই আনন্দ শুধু শিশুরাই বুঝে, আমরা কেবল অনুভব করি। এই শিশুরাই একদিন সত্যিকারের সংসার পাতবে, তারাও সংসারের ঘানি টানতে টানতে শ্রান্ত ও ক্লান্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। জনপ্রিয় এই খেলাটি দেশের কোন কোন অঞ্চলে’ আঁচাবাটি’বা টোপাভাতি নামে পরিচিত। ’টোপা’ অর্থ মাটির পাত্র আর’ ভাতি’হচ্ছে ভাত রান্না। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে টোপাভাতি খেলে অফুরান আনন্দ পায়। ঘরের কোণে বারান্দায় বা বাড়ির উঠানে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় তারা খেলার স্থান নির্বাচন করে। প্রয়োজনে ঝাড়– দিয়ে সরিয়ে নেয় ময়লা- আবর্জনা, ধুলাবালি। নগর জীবনে যেমন কম্পিউটার/মোবাইল প্রযুক্তি নিয়ে নারাচাড়ার মাধ্যমে নতুন কিছু দেখাতে পারলে বড়দের কাছে থেকে সারপ্রাইশ পাওয়া যায় তেমনি একসময় টোপাভাতির মত খেলায় বিশেষ দক্ষতা দেখাতে পারলে মুরুব্বীদের কাছ থেকে সারপ্রাইশ পাওয়া যেত।

আঁচাবাটি খেলায় কৃত্রিম ঘর তৈরি করা হয় এবং গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা টোপাভাতি খেলার জন্য সংসারের পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র যোগাড় করে রাখে। বিভিন্ন টিনের কোটা, কাগজের প্যাকেট, বোতল ভাঙ্গা প্লেট বা গ্লাস সবকিছুই তারা খেলার কাজে লাগায়। ছোট মাটির চুলা তৈরি করা হয়, অনেকসময় ৩টি ইট বা শক্ত মাটির ইটা দিয়ে বানানো হয় চুলা। ছোট পাতিলে রান্নার পর পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে নারিকেলের শক্ত খোল। মাটিরপাত্র ভাঙ্গা চারার কোণা ঘঁষে সমান করে তৈরি করা হয় কড়াই। সাধারণত চালের বিকল্প হিসেবে খুদ, ভাঙ্গা চাউল,শাক, সবজি দিয়ে খুদের ভাতই বেশিভাগ তৈরি করা হয়। কোন কোন এলাকায় এই প্রক্রিয়ার খিচুরি রান্না করা হয়। কলাপাতা, কচু ও কাঠালের পাতা দিয়ে প্লেটের কাজ চলে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে সংসারের কর্তা ব্যক্তি পুরুষ চলে যায় ঝোপঝাড়ে বাজার করতে। বাজারের ব্যাগ তৈরি করে সুপারি পাতার সঙ্গে থাকা খোলা,কলা গাছের খোলসবা খেজুর ফেতরা দিয়ে মাছ তরিতরকারি নামে মিছিমিছি কিছু বনপাতা, জঙ্গল,ফলমূল থলিভর্তি করে নিয়ে আসে। বাজার সওদা ব্যাগ বয়ে আনতে তার অবস্থা যেন নাভিশ^াস। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ধপ করে তা ছেড়ে দেয়। অভিনয়কারী গৃহিনীরা দ্রুত এগিয়ে এসে হায় হায় কত কষ্ট বলে আদর সোহাগ দিয়ে ব্যাগগুলো ধরে নেয়। অবশ্য গ্রামে টোপাভাতি খেলার অনেক সঙ্গীর মধ্যে পরিণত বয়সে জুটি বাঁধার অসংখ্য নজির রয়েছে। বাজার করে কর্তাবাড়ি ফেরার পর রান্নাবান্নার ধুম পড়ে যায়। মাছ তরকারি কেটে কুটে ধুয়ে চুলায় চড়িয়ে দেয়া হয়। জ¦ালানো হয় আগুন। পাকা রাধুনির মত ফু দিয়ে আগুন নেভানো ও জ¦ালানোর কাজও করা হয়। প্রচুর ধোয়া হচ্ছে দেখানো হয় এবং চোখ মুছে দেয়, এমনভাব দেখায় যে তারা খুবই ব্যস্ত। কি যে দৃশ্য না দেখলে বুঝার উপায় নেই। এভাবে আরো বিভিন্ন পদের অঙ্গিভঙ্গির মাধ্যমে শেষ হয় তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতির রান্ন। এরপর আসবে খাবারের পালা-রাধুনিরা নিজেদের রান্না অন্য সবাইকে না খাওয়াইয়ে নিজেরা তো খাবেই না। অভিনয়ের মাধ্যমে যারা মা, বাবা,ভাই বোন হয়েছেন তাদের কাছে খাবার আগে নিয়ে যায়া এবং তাদেরকে খুবই যতœসহকারে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। মুরুব্বীরা পিচ্চীদের ৃখুশী করতে ওরা যা বলে তাই করে,শুধু তাই নয় খাবার সম্পর্কে মন্তব্য না করা পর্যন্ত তাদের রেহাই মিলেনা। লবণ কম হয়েছে কিনা, ঝাল ঠিক হয়েছে কিনা, হলুদ বেশি হয়েছে কিনা প্রভৃতি মন্তব্য শুনে রাধুনিরা তৃপ্ত হয়। মুরুব্বিদের খাওয়ানোর পরই নিজেদের খাওয়ার পালা। মিছামিছি এই খাওয়া দাওয়া দেখে বয়স্কদের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। মুখে নানা ধরনের শব্দ (কৎমৎ,চপচপ) করে খাবার অভিনয় চলে বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বিছানায় যাবার পালা। মাটিতে টানটান করে তারা শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ, নাক ডাকা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর ধরপর করে জেগে ওঠে। কেউবা আলসেমির ভান করে। এভাবেই শেষ হয় গ্রামের শিশু কিশোরদের টোপাভাতি খেলা।
এই খেলার আনন্দ অনেকসময় নিরান্দতে পরিণত করে। খেলা নিয়ে অনেকসময় শুরু হয়ে যায় মাতামাতি ঝগড়াঝাটি, হৈহুল্লোড়, ইত্যাদি। তখন শিশুরা সাজানো খেলার ঘর রেগে মেগে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। পদদলিত করে মেকি সংসাারের জিনিসপত্র। শৈশবের সেই সকল স্মৃতি মনে হলেও অনেক নামিদামি ব্যক্তিরা এগুলো স্বীকার করেনা। আমরা লোকায়ত চর্চায় বিশ^াসী। আমরা শুধু স্বীকার নয় এই চর্চার প্রতি ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে যুগ যুগ টিকে থাকুক সেই প্রত্যাশা করি। লোকায়ত চর্চাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে বহুত্ববাদি সাংস্কৃতিক চর্চা আরো বেগবান হবে বলে আমরা বিশ^াস করি।

happy wheels 2

Comments