সাম্প্রতিক পোস্ট

বীজ অংকুরোদগমে কৃষকের স্থানীয় জ্ঞান

:: এবিএম তৌহিদুল আলম ::

হাজার বছর ধরে অসংখ্য কৃষকের শ্রম, ঘাম, মেধা আর সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলার কৃষি। আপন জ্ঞান, বংশ পরম্পরায় অর্জিত অভিজ্ঞতা আর স্থানীয় সম্পদকে দিয়ে এদেশের কৃষক উদ্ভাবন করেছেন ব্যবহার উপযোগী এমন সব  প্রযুক্তি যেগুলো পরিবেশ ও কৃষির স্থায়িত্বশীলতার জন্য সহায়ক। নোয়াখালির মো. আনোয়ার হোসেন (৪৭) এমনই একজন সৃজনশীল কৃষক যিনি তার এলাকায় মাটির অভাবে শস্য ফসলের বীজের অংকুরোদগমের জন্য বেছে নিয়েছেন স্থানীয় সহজপ্রাপ্য এমন একটি উপকরণ।

আনোয়ার হোসেনের বাড়ি নোয়াখালির চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর  ইউনিয়নের মলমমুড়ি গ্রামে। পাশের  গ্রাম ভাওর ও বারইপাড়ার মতো মলমমুড়ি গ্রামেও বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বেশিরভাগ ফসলী জমি পানির নিচে তলিয়ে থাকে। মেঘনার ভাঙন রোধের জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মহেন্দ্রখাল দখল, ভরাট ও পুনঃসংস্কারের অভাবে মৌসুমী জলাবদ্ধতায় পরিবেশগত এই সঙ্কটে মলমমুড়ি গ্রামে শুধু মাটি নয় পুরো কৃষি ব্যবস্থাই হুমকির মুখে। গ্রামের তিন ফসলী জমিগুলো প্রায় এক ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। এই বৈরী প্রতিকূলতা কৃষক আনোয়ার হোসেন নিজস্ব জ্ঞান, কৌশল ও বংশপরম্পরায় অর্জিত কৃষি অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অতিক্রম করতে চেয়েছেন নিজস্ব সীমিত সাধ্যের পরিসরেই। আপন অনুসন্ধিৎসায় তিনি বীজের অংকুরোদগমের জন্য স্থানীয় সম্পদ থেকে বেছে নিয়েছেন সহজলভ্য, সহজ প্রাপ্য এমন একটি উপকরণ যা তাকে কিনতে হয় না কখনোই। মলমমুড়ি গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মহেন্দ্রখালেই জন্মে প্রচুর কচুরিপানা। মাটির অভাবে এই কচুরিপানা তিনি ব্যবহার করেন সবজি বীজ অংকুরোগমের কাজে।

আনোয়ার হোসেনের কাছে কচুরিপানায় সবজি চারা গজানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাডি কই পামু, এইড্যা  অনেক সোজা কাম, খাডনি কম, চারা লইয়া হাটে হাটে যাওন সহজ’। আনোয়ার হোসেন জানালেন, এলাকায় মাটি যোগাড় করাটাই কঠিন, কেননা বেশিরভাগ জমিই পানির নিচে থাকে। কচুরিপানায় সবজি চারা অংকুরোদগমের তার এই কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈশাখ মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে দুইমাস পচানো হয় এরপর হাত দিয়ে পচা কচুরিপানা গোল মুঠো করে বল আকৃতির বানিয়ে তার মধ্যে বীজ ঢুকিয়ে দিতে হয়। এভাবে বীজ থেকে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চারা গজায়। মাটির তুলনায় কচুরিপানার বলে জন্মানো চারার সতেজতা বেশি বলে তিনি জানান। সাধারণত কিউকারবিটোসী পরিবারের সবজি যেমন লাউ, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, চিচিংগা, করলা বীজ এভাবে অংকুরোদগম করা হয়। আনোয়ার হোসেন জানালেন, বছরব্যাপী এভাবে বিভিন্ন ধরনের সবজি চারা কচুরিপানার বলে গজানো যায়। তবে একবার পচানো কচুরিপানা তিনমাস পর্যন্ত রাখা যায়। কচুরিপানার বল এ জন্মানো এই চারাগুলোতে ভাদ্র মাসের শেষে কখনো কখনো আদ্র আবহাওয়ার জন্য মড়ক দেখা দেয়। তখন কুয়াশা থেকে এই চারাগুলোকে রক্ষা করতে হয়। তিনি জানান এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৯৯% ভাগ বীজেরই অংকুরোদগম হয়।

আনোয়ার হোসেন জীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে নিয়েছেন নানান পেশা। কিন্তু বিগত বিশ বছর তিনি সব পেশা ছেড়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বছরব্যাপী কচুরিপানার বল’এ জন্মাচ্ছেন বিভিন্ন সবজি চারা। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত জৈব উপায়ে জন্মানো কচুরিপানার ছোট্ট ছোট্ট বলের ভেতর থেকে সদ্য গজানো অসংখ্য সবুজ সতেজ শিশু চারাগুলো যখন বাতাসে মাথা নাড়ায়  দেখে তার প্রাণ ভরে যায়। আনোয়ার হোসেন সারাবছর বিভিন্ন ধরনের সবজি মিলে প্রায় ২০০ কেজি বীজ থেকে কয়েক লাখ চারা  উৎপাদন  করেন। প্রতি ডজন চারা ৮-১০ টাকায় আশেপাশের বাজারে বিক্রি করেন। এই কাজে তার বাৎসরিক বিনিয়োগ প্রায় ৪৫ হাজার টাকা ।

পরিবেশিক বৈরিতা ও অনেক প্রতিকুলতা ও বহুমুখী সীমাবদ্ধতা সত্বেও স্থানিক সম্পদ ব্যবহার করে আনোয়ার হোসেনের এই উদ্ভাবন ও চিরচেনা কৃষি পেশায় টিকে থাকার এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানতেই হয়।

happy wheels 2

Comments