খেজুর গাছ সংরক্ষণে তরুণদের ভূমিকা
মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
বৃক্ষপ্রেমিক জীবনানন্দের ভাষায় সহসাই মুর্ত হয়েছে- “বসেছে বালিকা খর্জ্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কুলে”। বাংলার আরেক রূপ কবি সুফিনাজ নুরুন্নাহার এর ভাষায় “মায়ের হাতের রসের পিঠা, মধুর মত খেতে মিঠা।” মধুবৃক্ষ খেজুর পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিবান্ধব ও স্থানসাশ্রয়ী একটি বৃক্ষ প্রজাতি। খেজুর বৃক্ষ একবীজপত্রী ও আবৃতবীজপত্রী উদ্ভিদ। এই প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুকি মোকাবেলায় ও বিরূপ প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারে বিধায় দেশের সকল অঞ্চলে এই বৃক্ষ দেখা যায় এবং সমতল উঁচু নিচু নদীর পার, চরাঞ্চল লবণাক্ত মাটিতে ও বরেন্দ্র অঞ্চলেও খাপ খাইয়ে নিতে পারে। শীত ঋতুতে এই গাছ রসের বারতা নিয়ে আসে, ফাগুনে প্রকৃতিতে খেজুর ফুল ফোটে ও মানুষকে আকৃষ্ট করে, শীত ঋতুতে খেজুরের মাথিতে মুচি আসে, শুধু স্ত্রী গাছেই ফুল ও ফল ধরে পুং গাছে নয়। এই ফল বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকে, অত্যন্ত সুস্বাদু ও ভেষজ গুণ বিধায় গাছে থাকে পাখির আনাগোনা, শিশুদের ভিড় আবার কাচা খেজুর দিয়ে মায়েরা সুপারির পরিবর্তে পান খাওয়ার ও রেওয়াজ আছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর,সিংগাইর ও ঘিওরসহ সব অঞ্চলে।
দেশের সব অঞ্চলে এই বৃক্ষ দেখা গেলেও ফরিদপুর ও যশোরে বাণিজ্যিকভাবে দীর্ঘকাল ধরে খামারিরা খেজুর গাছ চাষ করে আসছে। ফলে সবচেয়ে বেশি রস ও খেজুর গুড় এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। আবার গুণগত মানের দিকে থেকে উৎকৃষ্টমানের গুড় তথা হাজারী গুড় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকাতে উৎপন্ন হয়। হাজারী গুরের সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়েছে এবং ব্রিটেনের রাণী ভিক্টেরিয়া এর স্বাদ গ্রহণ করতে ভুল করেনি।
ইতেমধ্যে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসন জেলার ব্র্যান্ডিং নির্বাচন করেছেন “লোকসংগীত ও হাজারী গুড় মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর” এই ব্র্যান্ডিং নির্বাচনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এর সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন বর্তমান জেলা প্রশাসক নাজমুছ সাদাত সেলিম। বারসিক মানিকগঞ্জ এলাকা সমন্বয়কারি বিমল রায় জানান, জেলা প্রশাসকের আয়োজনে বারসিক এর সহযোগিতায় হরিরামপুর উপজেলা থেকে প্রাকৃতিক উৎস সুরক্ষা ও হাজারী গুরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে খেজুর বীজ রোপণের যাত্রা শুরু হয়। ইতেমধ্যে বারসিক এর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা কিছু সেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন তারুণ্যের আলো যুব সংগঠন, ইয়ুথ গ্রীণ ক্লাব, ওপেন ফ্রেন্ডস ক্লাব, চর জলবায়ু সেচ্ছাসেবক টিমসহ স্থানীয় যুব ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ঐকান্তিক সেচ্ছাশ্রমে প্রায় সাড়ে তিন মণ খেজুর বীজ জেলার হরিরামপুর, সিংগাইর, ঘিওর ও মানিকগঞ্জ সদরের বিভিন্ন গ্রামে রোপণ করা হয়েছে। এই রোপণ প্রক্রিয়া যুবকদের মাধ্যমে প্রতিবছরেই আরো বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের চারাভাঙ্গা গ্রামের গাছী কিসমত মিয়া বলেন, “খেজুর গাছ আগের তুলনায় অনেক কম এবং রস থেকে গুড় তৈরিতে যে পরিমাণ জ্বালানি লাগে সেটি এখন খুবই দুস্কর, গুড় তৈরিতে ধানের খড়, নারা, খেসারি, মসুরি ও সরিষার ডগা খুবই ভালো।”
হরিরামপুর উপজেলার দিয়াবাড়ী গ্রামের উন্নয়নকর্মী ডা. মাসুদুর রহমান বলেন, “এই উদ্ভিদ মানবদেহের জন্য উপকারি বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান দ্বারা সমৃদ্ধ। খেজুর ফল ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ। প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সাশ্রয়ী পুষ্টিকর ও উপাদেয়। খেজুর রসে এ্যসপেরাটিক এসিড, নাইট্রিক এসিড ও থায়ামিন বিদ্যমান। প্রাকৃতিক অথবা চারা বা বীজ থেকে খেজুর গাছ হয়।” তিনি আরও বলেন, “এই গাছ ফল ও রস দিতে কমপক্ষে ৮-১০ বছর সময় লাগে এবং প্রায় ২৫-৩৫ বছর পর্যন্ত অবিরাম ফল ও রস দিয়ে থাকে।” সিংগাইর উপজেলার বকচর গ্রামের নয়ন গাছীর স্ত্রী কৃষাণী জুলেখা বেগম বলেন, “এই গাছের উপকারের কথা বলে শেষ নেই। এই গাছের সবকিছুই কাজে লাগে।”
খেজুর গাছে পাখির কিচিরমিচির সারাবছরই শোনা যায়। খেজুর গাছ হলো পাখির নিরাপদ আশ্রয়। বিশেষত শালিক, ঘুঘু, কাক, ময়না, মটুসি নরম ফল খায় ও বাচ্চা ফুটিয়ে তাদেরকে খাওয়াতে পারে। পাখি প্রকৃতি ও প্রতিবেশের পরম বন্ধু তাই পাখির অভায়াশ্রম তৈরিতে খেজুর গাছের অবদান কম নয়।
খেজুরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের জীবন জীবিকার সংগ্রাম, গ্রামীণ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রাণ-প্রকৃতি প্রতিবেশ রক্ষার হাতিয়ার। কিন্তু আজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও খরার কারণে গাছগুলো বেঁেচ থাকলেও খেজুর রস ও ফলের উৎপাদন খুবই কম। আশংকাজনকভাবে বসতবাড়িতে খেজুর গাছের আধিক্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, জ্বালানির অভাবে খামারিরা বাণিজ্যিকভাবে খেজুর চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তবে আশার কথা বর্তমান সরকারের বন বিভাগ ও কৃষি বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে খেজুর গাছ রোপন করার উদ্যোগ নিয়েছে।