হাওরাঞ্চলের সুন্দরবন
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
সুন্দরবন নামটি শুনলেই চোখে ভাসে ম্যাঙগ্রোভ বন, রঙেল বেঙ্গল টাইগার, মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালদের বিচরণ প্রভৃতি দৃশ্য। কিন্তু এখানে এমন কোন বনের কথা বলা হচ্ছে না। এখানে হাওরাঞ্চলের সুন্দরবন ফুলের কথা বলা হচ্ছে। যা কলমাকান্দা উপজেলার হাওর ও হাওর অধ্যূষিত এলাকার হাওর, নদী, নালা, খাল, বিল, বন, জঙ্গল ও পথের ধারে জন্মে। এটি অত্র এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের সাথে মিশে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বর্ধনেও ভূমিকা রাখছে।
ফুলের বিবরণ
এলাকা বিশেষে একে স্থানীয়ভাবে সুন্দরবন বা ফুলের লেদা বলা হয়। এই এলাকায় এটি ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের দিকে চারা গজায়। মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে মে-জুন পর্যন্ত থাকে। এরই সাথে সাথে সরিষা দানার মত বীজও পরিপক্ক হতে শুরু করে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা জানান, ফুল ফোটার ১-২ মাসের মধ্যেই ফুল থেকে ফল হয় এবং প্রায় ১৫-২০ দিনের মধ্যে বীজ পরিপক্ক হয়। এরপর বর্ষাকাল আসলে গাছগুলো পানির নীচে তলিয়ে যায়, গাছ পচে যায়। কিন্তু এর বীজ অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদ ও আগাছার মতই প্রাকৃতিকভাবে কাঁদা মাটি বা ঝুপ ঝাড়ের মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে দীর্ঘদিন। অতঃপর নির্দিষ্ট ও উপযুক্ত সময়ে আবার প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাতে শুরু করে। সুন্দরবন গাছের উচ্চতা প্রায় ৫-৭ ফিট পর্যন্ত হয়। গাছটি নরম কাটাযুক্ত। ছোট আকৃতির ঘন সবুজ পাতা দিয়ে পুরো ডাল ঢাকা থাকে। ৪-৫টি পাপড়িযুক্ত বেগুনি ও গোলাপি রঙের ফুল হয়। এর বীজ দেখতে প্রায় সরিষা দানার মত। তবে আকারে সরিষা থেকেও আরো ছোট হয়। এর ফুল ও পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহার হয়। ফুল হিন্দু সম্প্রদায়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়। গাছ কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা ছাড়াও লাকড়ি (জ্বালানি) হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর বীজ থেকে যে তৈল হয় তা ঔষধি কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
অচাষকৃত খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার
গ্রামাঞ্চলে এক একটি পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অচাষকৃত উদ্ভিদের গুরুত্ব অনেক। হাওরাঞ্চলে অচাষকৃত নানান জাতের খাদ্যের মধ্যে সুন্দরবন একটি। সবজি হিসেবে এর ব্যবহার সম্পর্কে বরখাপন ইউনিয়নের কাগজিপাড়া গ্রামের সাধনা রানী দাস (৪৫) বলেন, “আমরা ফুল বড়া কইরা খাই, কচি পাতাগুলা রান্না কইরা খাই। পুরনো গাছ লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করি। এইনিতেই সবখানে গজায় বইল্যা যখন খাইতে মন চায় তখনি আইন্যা রান্না কইরা খাওয়া যায়। আবার অনেকসময় শাক সবজি কিনার টাকা থাকেনা এই সময়ও বাড়ির আশপাশ থেইকা তুইল্যা আইন্যা এক বেলার সবজি হিসেবে চালাইয়া দিতে পারি।”
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার
হিন্দু সম্প্রদায়ের নানান ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে সুন্দরবন ফুলের বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার রয়েছে। এ সম্পর্কে নাগঢড়া গ্রামের মিলন রানী দাস (৩৮) বলেন, “ফাল্গুন-চৈত্র মাসে চৈত্র পরত অনুষ্ঠানের সময় গরাদি পশুর মঙ্গল কামনায় এই ফুলটা দিয়া পুজা অনুষ্ঠান করি। এই অনুষ্ঠানটি করতে প্রথমে গছি বসাই তারউপর শুকনো সুন্দরবন গাছ রাইখ্যা ধূমা (ধূয়া) দিই। তার সামনে সুন্দরবন ফুল, কলার পাতা, দূর্ব্বা, ধান, সিদুর, বেলপাতা, তুলসী, আমের ডগা, জলঘট রাইখ্যা গরুর শরীরে ধূমা দিই। যেনো গরু সারাবছর ভালো থাকে, রোগ মুক্ত থাকে।” সুনিতি দাস (৪০) বলেন, “ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে ঘরের মানুষের মঙ্গল কামনায় গাদাবান্দা অনুষ্ঠানের সময় সুন্দরবন ফুল লাগে। এই সময় আমরা প্রথমে ঘর লিপি, তারপর সন্ধাবেলা গোবর, ধান, দূর্ব্বা, লাউ ফুল ও সুন্দরবন ফুল দিয়া ঘরের দূয়াঁর সাজায়। পরের দিন সকাল পর্যন্ত রাইখ্যা ফালাইয়া দিই। এতে সারাবছর ঘরের মানুষের মঙ্গল হয়।”
সুন্দরবনের তৈল ও ঔষধি গুণাগুণ
সুন্দরবনের বীজ থেকে তৈল করা যায় ও এর কিছু ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে। এ সম্পর্কে একই গ্রামের শ্যামা চরণ দাস (৬৩) বলেন, “আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন নাগঢড়া গ্রামের হাওর ও নদীর পাড়ে, রাস্তার ধারে, বিরানভূমিতে অনেক সুন্দরবন গাছ আছিল, দেখতে অনেক জায়গা জুইরা ফুলের বাগানের মত লাগতো। ফুলে অনেক মৌমাছি, প্রজাতি, ফরিং আরো কত পোঁকামাকর বইতো। আমরা এর বীজ সংগ্রহ করতাম, আর সরিষার মত বীজ থেইকা তৈল বাইর করতাম। ৪-৫ কেজি বীজ থেইক্যা ১ কেজি তৈল বাইর হইতো। এই তৈল দিয়াই রান্না চলতো। রান্না করার লাইগ্যা তৈল কিনা লাগতোনা কয়েক মাস পর্যন্ত। এর তৈলের রং সরিষা তৈল থেকেও লাল, সুন্দর ও সুগন্ধযুক্ত হয়। এর তৈল শরীরে ঘা হইলে, শরীর চুলকাইলে মাখতাম। ভালো হইয়া যাইতো।”
তিনি আরো বলেন, “এখন জনসংখ্যা বাড়তাছে, বিরানভূমি সব ফসলী জমি করতাছে গাছগুলা জন্মানোর কোন জায়গা নাই। তাছাড়া বোরো ফসল চাষের সময় বেশি পরিমাণে সার বিষ দেওয়াতে এর বীজ নষ্ট হইয়া যাইতাছে। ফসল ও শাকসবজির বাগানে চারা জন্মাইলে আগাছা বইল্যা গাছগুলা উপড়াইয়া ফালাইয়া দিতাছে। সুন্দরবন চাষ কইরা তৈলের চাহিদা পূরণ করার সুযোগ আছিল।”
কালের বিবর্তনে এই ফুল এখন বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে হাওরঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ দিন দিন সংকূচিত হচ্ছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দূর্যোগের কারণে। তাই আমরা হারাতে বসেছি প্রকৃতির অনেক মূল্যবান উপাদান, উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও। ফলশ্রুতিতে বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও মুখোমুখি হচ্ছি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাবের। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য প্রকৃতির প্রাকৃতিকতা সঠিক রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।