মাছ ধরার যন্ত্র কোঁচ এর ব্যবহার স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীন কালের কথা

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল এলাকার সৌখিন মানুষেরা প্রতিবছর আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত যে সকল যন্ত্র দিয়ে মাছ ধরে থাকেন তার মধ্যে কোঁচ অন্যতম। চলনবিল সংকুচিত হবার ফলে দিন দিন কোঁচের ব্যবহার কমে আসলেও এখনো কোঁচ দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় সৌখিন মানুষদেরকে। বর্শা জাতীয় দশ পনেরোটি অগ্রভাগ তীক্ষè ধারালো গোলাকার লোহার টুকরো বাঁশের চোখা অগ্রভাগ গুলোর মাথায় পরিয়ে দিয়ে কোঁচ বানানো হয়। দূর থেকে নিক্ষেপ যোগ্য করার জন্য অপর একটি বাঁশের সাথে এ অংশ জোড়া দেওয়া হয়। মৎস শিকারীরা দূর থেকে মাছ ধরার এ যন্ত্র মাছকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করে ঘায়েল করে বড় বড় মাছ শিকার করেন। এ ছাড়া লোহার এমনই এককাঁটা, তেকাঁটা ব্যবহার করেও অনেকে মাছ ধরে থাকেন। অনেকে লোহার অগ্রভাগে কালা বা আল তৈরী করে নেন যেন কোঁচ এককাঁটা বা তেকাঁটায় বিদ্ধ হওয়া মাছ ছুটে যেতে না পারে।

coach-1সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের তাড়াশের হামকুড়িয়া ও পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়ালের বহিরগাতি গ্রামের মধ্যবর্তী মরাবিলে কোঁচ দিয়ে মাছ শিকার করছিলেন বহিরগাতি গ্রামের আসগার আলী। তিনি বলেন, “কোঁচ দিয়ে মাছ মারা একটা নেশা। কখনো মাছ পাই কখনো পাই না। আষাঢ় মাসে বিলে যখন পানি পড়ে তখন ডিম ছাড়ার জন্য পানির সাথে বড় বড় মা বোয়াল মাছ আসে। এগুলোকে আমরা পীরের মাছ বা হালির মাছ বলি। কোঁচ দিয়ে পীরের মাছ মারার জন্য তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে সৌখিন মাছ শিকারীরা চলন বিলে ভীড় জমান। এর পর শ্রাবণ মাসের শেষ দিকটায় যখন আমন ধান গুলো পানিতে দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে তখন থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে কোঁচ দিয়ে ষোল বোয়াল রুই কাতলাসহ কার্পজাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মারেন মৎস শিকারীরা। আশি^ন মাসে ধান গাছ গুলো ফুলে গেলে তখন আর নৌকা নিয়ে ধান ক্ষেতে ঢুকতে দেয় না জমির মালিকরা।”

coach-2একটু দুরেই ডিঙি নৌকা নিয়ে কোঁচ দিয়ে মাছ শিকার করছিলেন বাঘলবাড়ি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে মনির হোসেন ও একই গ্রামের আবু বকরের ছেলে সুলতান হোসেন। একজন কোঁচ হাতে বিলের পানিতে মাছ খুঁজছিলেন। লগি দিয়ে নৌকা ঠেলার সময় পানিতে ঢেউ হলে মাছ বুঝতে পেরে দ্রুত অন্য এলাকায় সরে যায়; অপরজন তাই অতি সন্তর্পণে লগি ঠেলে এগিয়ে নিচ্ছিলেন নৌকা। ভাগে মাছ মারেন তারা। যে মাছই পান না কেন দুজন কেটে ভাগ করে নেন। মনির ও সুলতান বলেন,“শখের বশে কোঁচ দিয়ে মাছ শিকার করি। প্রখর রোদ্র তাপ উপেক্ষা করেও মাছের নেশায় ছুটে চলি এ বিল থেকে ও বিলে। তবে যখন মাছ পেয়ে যাই তখন খুব ভাল লাগে। ভুলে যাই রোদ বৃষ্টির কথা।” মাছগুলো কখনো ঝাঁকে চলে আবার কখনো একাই চলে। মাছ যখন পানি ভেঙে এগিয়ে আসে তখন দুরত্ব আন্দাজ করে মাছের কিছু অগ্রভাগে কোঁচ নিক্ষেপ করতে হয়। কোন কোন বছর যখন বড় বন্যা হয়, পুকুরে চাষকৃত মাছ ভেসে যায় তখন বিলে কোঁচের মাছ বেশি হয়। সাধারণত দুপুর থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত কোঁচ দিয়ে মাছ মারেন চলনবিল এলাকার মানুষ।

আসগার, মনির ও সুলতান এর মতো বাগলবাড়ি এলাকার আব্দুল, ইমান, হারেছ, হামকুড়িয়া গ্রামের সাইদুল, শামসুসহ চলনবিল অধ্যুষিত এলাকার সৌখিন অনেক মাছ শিকারী প্রতিবছর বর্ষায় মাতেন কোঁচ দিয়ে মাছ শিকারের আনন্দে। মাছ ধরার আধুনিক অনেক উপকরণ বা যন্ত্র আবিষ্কার হলে কোঁচের ব্যবহার অনেক কমে আসলেও এর আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এটি আমাদের প্রাচীন কালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

happy wheels 2

Comments