চরে হোগলা ফুলের ব্যবহার
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন ও সত্যরঞ্জন সাহা
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর তীরে জেগে উঠা চরে দিকে তাকালেই দেখা যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চরের হাজার বর্গমাইলজুড়ে চোখ জুড়ানো হোগলা ও কাঁশবন। ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশের প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন সাজে। নদীর পাশে খোলা জায়গায় ঘন হোগলা ও কাশবনের সাদা ফুলের উঁকিঝুকি জানান দেয় শরৎকাল। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, শুভ্রতা, কোমলতা, মনোমুগ্ধতার জন্যই শরৎ ঋতুকে বলা হয় ঋতুরাণী। হোগলা ও ফুলের স্নিগ্ধ বাতাস আর প্রকৃতির সকল প্রাণকে দোলায়িত করে। প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্যে চরের হোগলা ও কাঁশবনের প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে বাতাসে বীজ ছড়িয়ে সম্প্রসারণ করে। রক্ষা করে নদী তীরসহ বন্য প্রাণিকে। হোগলা ও কাঁশবনে প্রাণবৈচিত্র্যের খাবারের আধার। চরের হোগলা, কাইশ্যা, ছোন, বন, নলখাগড়া চরের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙন ও মাটির ক্ষয় রোধসহ চরের মানুষের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
অপরদিকে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে কাইশ্যা, হোগলা, নলখাগড়া (ঘর তৈরিতে বেড়া, উপরের চালা, জ্বালানি, গো-খাদ্য, বসার পাটি তৈরির করে জীবন জীবিকার উন্নয়নে কাজ করছে। এই প্রসঙ্গে আন্ধারমানিক গ্রামের গফফার মোল্লা (৫২) জানান, আন্দারমানিক, খালপাড় বয়রা, দড়িকান্দি, পাটগ্রামচর, খরিয়া, হালুয়াঘাটা গ্রামের প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষ নদীর চরে জন্ম নেওয়া উদ্ভিদ কাইশ্যা, হোগলা, নলখাগড়া আশ্বিন মাস থেকে অগ্রাহায়ণ মাস পর্যন্ত (তিন মাস) সংগ্রহ করে থাকেন। নারীরা জ্বালানি সংগ্রহ, ঘরের বেড়া, পাটি, ঘরের ছাইনী কাজে ব্যবহার করেন। সংগ্রহকৃত জ্বালানি রোদ্রে শুকিয়ে আটি বেঁধে ঘরে মাচার উপর রাখে। আষাঢ় থেকে ভাদ্র পর্যন্ত মাস বর্ষাকালে নারীরা রান্নার কাজে জ্বালানি হিসাবে হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া ব্যবহার করে থাকে ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ নদী ভাঙন এবং মাটি ক্ষয়রোধে হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া পানির ঢেউ, স্রোতকে গতি রোধে বাধা সৃষ্টি করে। হোগলার গাছের শিকড় মাটির নিচে ৫/৬ হাত পর্যন্ত লম্বা হয় ফলে মাটির ক্ষয়রোধে সহায়ক। স্থানীয় মানুষ নদীর তীরবর্তী এলাকায় বিশেষ করে এক বিঘা পর্যন্ত ছন, কাইশ্যা, হানা (কাইশা জাতীয়), খইগাছ, নলখাগড়া কাটে না, ফলে মাটি ধরে রাখতে ও নদী ভাঙন রোধে সহায়তা হয়।
গবাদি পশুর খাদ্য নিরাপত্তায় চরের মাটিতে জেগে ওঠা কাইশ্যা, নলখাগড়া, গইচা, পাইনা, দুবলা, বাদলা, খরমা, কলমি ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। চরে প্রতিটি পরিবারে ৪/৫টি গরু জীবকায়নে সহযোগী। চরে প্রতিটি পরিবারে রয়েছে হোগলার ফুলের বালিশ, লেপ, তোষক এবং বিশেষ করে হোগলার পাতার পাটি দরিদ্র মানুষের চেয়ার হিসাবে কাজ করে। এই বিষয়ে পাটগ্রামচরের কৃষাণী আইরিন বেগম (৩৫) বলেন, “দিনদিন শিমুল গাছ কমে যাচ্ছে এবং শিমুল তুলার দাম অনেক যা আমদের মত গরিব মানুষের কেনার সামর্থ নাই। তাই আমরা চরে হোগলা ফুল তুলে এনে এর তুলা দিয়ে বালিশ, লেপ, তোষক তৈরি করি। আমাদের কোন টাকা পয়স্ াখরচ হয় না। হোগলা ফুলের বাইল (শিশ) চর থেকে সংগ্রহ করে এনে দু’দিন রোদে শুকিয়ে তার আশগুলো ছাড়িয়ে জ্জ ভালো করে শুকিয়ে পলিথিন ব্যাগে রেখে সময়মত বালিশ, লেপ ও তোষক তৈরির কাজে ব্যববহার করি।” তিনি আরও বলেন, “বাড়িতে অতিথি আসলে হোগলার পাটি দিয়ে বসতে দিই। হোগলার পাটি বিছানায়, জায়নামাজ, দস্তর খানাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। কাঁশবনে, শিয়াল, বেজী, সাপ, গুইসাপ, ইদুর, খাটাস, কীট পতঙ্গ বিভিন্ন ধরনের ভাত শালিক, গুশালিক, চড়ই, বাবই, কানা কুড়হা, পাখি বাস করে। পশু পাখির নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। পদ্মা নদী ও কাঁশবন থেকে তারা খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে।”
এলাকার লোকজন চরে কইশ্যা বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। চর এলাকার লোকজন প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া কাইশ্যা প্রতি ১বিঘা (৩৩শতক) জমির ১২০০/১৫০০ টাকা বিক্রি করে। ঢাকা, বরিশাল, যশোর থেকে ব্যাপারী এসে কিনে নিয়ে যান। কাইশ্যা পানের বরের মাচা, বেড়া দেওয়ার কজে ব্যবহার করেন। চরে পতিত জায়গা জন্ম নেওয়া হোগলা, কাইশ্যা, নলখাগড়া, ছোন মানুষের জীবন জীবিকার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মৌলিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চরের কাঁশবন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও খাদ্যের উৎস হিসেবে সহায়কের কাজ করে। বারসিক চরের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও ব্যবহার চর্চার মাধ্যমে চরের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে।