অবহেলিত বুনো ফুল ও প্রান্তিক জনের ভালোবাসা
নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর ও শংকর ম্রং
‘আজি এ বসন্তে, কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে, কত পাখি গায়…. আহা অজি এ বসন্তে’। ১৩ ফেব্রুয়ারি (১লা ফাল্গুন) শুরু হয় ফাল্গুন। শহরাঞ্চলে প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনী তেননভাবে বোঝা না গেলেও গ্রামাঞ্চলে বসন্তের আগমনী পুরোদমে বোঝা যায়। গাছের শুকনোপাতা মড়মড় শব্দে যখন উড়তে উড়তে মাটিতে পড়া, গাছে গাছে কোকিলের কুহু কুহু ডাক জানান দেয় বসন্ত এসেছে। প্রকৃতি শহরাঞ্চলে বসন্তের আগমনী বাণী গ্রামাঞ্চলের ন্যায় জানান না দিলেও, কোকিলের কুহু কুহু ডাক শোনা না গেলেও শহরবাসীরা কিন্তু অধীর আগ্রহে মহা আনন্দে বসন্ত বরণের প্রতীক্ষা করে। বসন্ত বরণের জন্য শহরের মানুষ একমাস যাবত প্রস্ততি নেয়। বসন্ত বরণকে ঘিরে শহরবাসীরা রঙিন ফুল আর বাসন্তি রঙের কাপড় পড়ে বাংলার গ্রামীণ লোক সংস্কৃতিতে দিনটি উদ্যাপন করেন।
কিন্তু বাংলা ষড় ঋতুর অন্যতম ঋতু বসন্তকে ঘিরে গ্রামবাসীদের কিন্তু তেমন কোন তরজোর নেই। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বুনো ফুলের মালা গেঁথে, বুনো ফুল খোঁপায় গেঁথে গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি বাউল গান, জারি, সারি, পালাগান, কবিগান, পুঁথি পাঠ, গল্পের আসর, পিঠাপুলি তৈরি করে সকলে মিলে আনন্দের সাথে খাওয়া ইত্যাদি অনুুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্য দিয়ে বসন্তবরণ করত। বর্তমান সময়ে উপজেলা পর্যায়ে ও গ্রামাঞ্চলের কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ক্ষুদ্র পরিসরে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং শিক্ষার্থীরা বসন্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নিলেও গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠী বসন্ত বরণের কথা মনেও রাখেনা।
বসন্ত বরণের পরের দিনই ২রা ফাল্গুন বা ১৪ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সকল প্রেমিক-প্রেমিকা বা ভালোবাসার মানুষের নিকট একটি বিশেষ দিন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তাই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এ দিনটি আনন্দের সাথে পালিত হয়। বিশেষভাবে আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তাদের প্রিয় মানুষকে ফুল দিয়ে এবং বিভিন্ন উপহার ও বাণী দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
কিন্তু এক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের নারীরা। স্বরমুশিয়া গ্রামের ‘হাবাদা’ (হাত বাঁশ দা’) নারী সংগঠনের উদ্যোগে এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস একান্ত গ্রামীণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে ৫টি জনসংগঠন এবং দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৭০ জন নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে পরস্পরকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা বিনিময় করেন।
এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ়করণে সংগঠনের সদস্যরা পরস্পরকে গ্রামের আনাচে কানাচে জন্মানো বুনো ফুল ও চাষ করা ফুল দিয়ে ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা জানায়। রামজীবনপুর গ্রামে হাবাদা জনসংগঠন আয়োজিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের জেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির আহব্বায়ক মো. সায়েদ আহম্মদ খান বাচ্চু এবং উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ খান।
সংগঠনের সদস্য হাওয়া আক্তার বলেন, ‘আমরা দরিদ্র হলেও আমাদেরও মন আছে, আমরাও ভালোবাসতে জানি। আমরা হয়তো দামী ফুল কিনে কাউকে ভালোবাসা জানাতে পারবনা, কিন্তু আমাদের চারপাশে অনেক বুনো ফুল ফুটে আছে, যে ফুলগুলো অবহেলা অনাদরে নষ্ট হয়ে যায়। এসব বুনো ফুল শুধুমাত্র মৌমাছি, প্রজাপতি ও বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গের নিকটই কদর পেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু সৌন্দর্য প্রিয় লোকেরা এসব বুনো ফুলের কদর দিয়ে থাকে। আমরা আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এসব কুড়িয়ে পাওয়া বুনো ফুল পরস্পরকে দিয়ে ভালোবাসা বিনিময় করছি। পাশাপাশি বুনো ফুলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জানাচ্ছি। আমরা প্রবীণ নারীদের ফুল দিয়ে বরণ করেছি, এতে তারাও খুব আনন্দিত হয়েছে।’
ভালোবাসা চিরন্তন, সর্বদা, সর্ব স্থানে ও সকলের মনে বিরাজমান। ভালোবাসা ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, পেশা, বয়স সকলেই কাঙ্খিত। কিন্তু এই পার্থিব জগতে বাহ্যিক বস্তুর মোহে পড়ে আমরা ভালোবাসার কথা ভূলে যাই। বর্তমান সময়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বড়ই অভাব, মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন কিছুর বিনিময়ে ভালোবাসে। সত্যিকারের ভালোবাসার অভাব হলেই ঘটে যত অনাকাঙ্খিত ঘটনার। হাবাদা নারী সংগঠনের সদস্যদের সমমনা ও সম পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে পরস্পরকে ফুল দিয়ে আপন করে নেয়ার উদ্যোগটি সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। জনসংগঠনের এই উদ্যোগের ফলে স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। সংগঠনগুলো এলাকার উন্নয়নে এবং পরস্পরের বিপদে আপদে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে এক যোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। এই ভালোবাসা যেন সর্বদা স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে সর্বদা সর্বত্র বিরাজিত থাকে এই আমাদের প্রত্যাশা।