গল্প নয় জীবন থেকে বলছি
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
‘বেঁচে ফিরব কি ফিরব জানিনা, সময়ের প্রয়োজনে পিছনে না তাকিয়ে স্থির লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা ঘর ছেড়েছি ,আমাদের একটাই লক্ষ্য, দেশকে মুক্ত করা।’ কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের পাঁচকাহনীয়া গ্রামের এক জন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা শের মোহাম্মদ।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমতলা ইউনিয়নের দেওপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে‘ মুক্তি যোদ্ধের গল্প বলার আসরে অংশগ্রহণ করে পাঁচকাহনীয়া গ্রামের প্রায় সত্তর বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা শের মোহাম্মদ।
নতুন প্রজন্মের সামনে দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা ও দেশ প্রেম জাগ্রত করণের লক্ষ্যে বারসিক ও স্কুলের শিক্ষকদের উদ্যোগে এ আসরের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, একজন সাধারণ লন্ড্রির দোকানে কাপড় ইস্ত্রি করে সারাজীবন কাটিয়েছেন। কতগুলো কাপড় ইস্ত্রি করবে তার অর্ধেক দোকান মালিক অর্ধেক তিনি পেতেন। নিজের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে নিজের সন্তানদের তেমন পড়াশুনা করাতে পারেননি। তিন ছেলে, তিন মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে সারাবছর অনেক কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। ছেলেরা এখন দিন মজুরীর কাজ করেন, এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন, দুই মেয়ে পড়াশুনা করছে।
বর্তমান সরকার এখন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আগের তুলনায় বাড়ানোর ও কাপড় ইস্ত্রি মত পরিশ্রমের কাজটি আগের মত করতে না পারায় এখন বাড়িতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর পর যোদ্ধের স্মৃতিগুলো যখন কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, স্মৃতি পাতা থেকে তখন বারসিক আয়োজিত এ গল্পে বলার আসরে এসে নিজের জীবনে সবচেয়ে গর্বের, সবচেয়ে বড় পাওয়া কিছু কথা শিক্ষার্থীদের সামনে বলতে গিয়ে তিনি খুব গর্ববোধ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শের মোহাম্মদ তার আলোচনা যুদ্ধকালিন সময়ে কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য সময়ে মূহুর্তগুলো গল্পের মতো করে বলে যান। কি পাবেন কি হবে, বেঁচে থাকবেন কিনা, কোন কিছু না ভেবেই শুধুমাত্র দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে একজন সাধারণ লন্ড্রির দোকানে ইস্ত্রিওয়ালা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে পারেন সে গল্প অবাক হয়ে শুনছিলেন গল্প বলার আসরে শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ কালীন সময়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমার হাত বেঁধে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল, ক্যাম্পের সামনে দাঁড় করিয়ে বন্ধুক তাক করে বলল বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আমি চুপ, আমার মাথায় তখন কেবলই মনে হচ্ছে আর কয়েক সেকেন্ড পর আর আমি এ পৃথিবীতে থাকব না, সাক্ষাত মৃত্যু জেনেও এ ভাবে কয়েকবার বলার পর আমি বললাম আমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবনা, আমি বাঙালি, আমার দেশ বাংলা। আমার সে কথায় কি ছিল আমি জানিনা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্ধুক নামিয়ে বলেছিল এ সাচ্চা আদমি আছে ছেরেদে একে। আমাকে ক্যাম্পের বাইরে নামিয়ে দিয়েছিল। ক্যাম্পের বাইরে এসেও আমার বিশ্বাস হয়নি আমি বেঁচে আছি।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইদুল হাসান খান তার বক্তব্যে বলেন, ‘স্বাধীনতার মাসে আজ একজন এমন ব্যক্তির সাথে তোমরা পরিচিত হলে যিনি আমাদের দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, এ কোন গল্প নয় এগুলো জীবন থেকে বলছেন, তোমরা যখন বই পড়ে কোন মুক্তিযোদ্ধার কথা পড় সেটা শিখতে তোমাদের অনেক সময় লেগে যায় কারণ আমরা যখন যুদ্ধের গল্প পড়ি তখন এগুলো কোন গল্প বলেই মনে করি কিন্তু আজ দেখ তোমাদের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন।’