নিম্নআয়ের মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে

ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

ঢাকার মোহাম্মদপুর বস্তিতে থাকেন জমিলা খাতুন। বাসাবাড়িতে কাজ করে মাসে রোজগার হয় চার হাজার টাকা। স্বামী রিকশা চালান। ছয়জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। বর্ষার দিনে কাজে যেতে সমস্যা হয়। কোনো নোটিশ ছাড়াই কাজ চলে যায়। জমিলা খাতুন তার মতো শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন ‘জাতীয় বাজেট ও নগরের বস্তিবাসী নিম্নআয়ের মানুষের ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে। বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন পবা যৌথভাবে ২৫ জুন এই বাজেট বৈঠক আয়োজন করে। পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ঐক্যন্যাপের পংকজ ভট্টাচার্য। আলোচনা করেন নগর দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীর আলম, গবেষক পাভেল পার্থ, বারসিক প্রতিনিধি সুদিপ্তা কর্মকার, নৃবিজ্ঞানী সৈয়দ আলী বিশ্বাস, বস্তিবাসী ইউনিয়নের নেতা কুলসুম বেগম এবং রাফেসা বেগম। মোহাম্মদপুর বস্তির নাছিমা বেগম, ঝুমুর বেগম, নূরুজ্জামান, কুদ্দুস মিয়া প্রমুখ বৈঠকের শুরুতেই নগরের নিম্নআয়ের মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের দাবিগুলো তুলে ধরেন। গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল।

IMG_8827

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষেরাই নিজেদের রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছি। দেশের বাজেটে আমাদের সকল মানুষের চাহিদার প্রতিফলন থাকতে হবে। কিন্তু গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কোনো বাজেট হয় না। বাজেট হয় কালোটাকার মালিক, হারামখোর আর ধনীদের স্বার্থে। সংবিধান থেকে শুরু করে নির্বাচনী ইশতেহার সর্বত্র গরিব মানুষের উন্নয়নের উপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও শহরের বস্তিবাসী নিম্নআয়ের মানুষেরা অধিকারবঞ্চিত ও নিষ্পেষিত। বস্তিবাসীদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের জন্য জাতীয় বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। প্রতিজন বস্তিবাসীর জন্য সরকারিভাবে ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পরিচয়কার্ড দিতে হবে।’

সভা প্রধানের বক্তব্যে পবার চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সকল উন্নয়ন উদ্যোগ একইভাবে সকলের জন্য কাজে লাগছে না। শহর ও গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষরা সবচেয়ে অবহেলিত। তাই তাদের জন্য পৃথক উন্নয়ন উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা।’ তিনি আরো বলেন, ‘সকল বস্তিবাসীদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার উদ্যোগ নিতে হবে।’

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, ‘২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে মাথাপিছু গড় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০,৭৭৬ টাকা। কিন্তু এই বাজেটে নগর দারিদ্র মানুষের কথা কোন স্থানেই সুস্পষ্টভাবে স্থান পায়নি। ঢাকা শহরে প্রায় ৫ হাজার বস্তি রয়েছে। বারসিক’র গবেষণায় দেখা যায় বন্যা, নদী ভাঙ্গন এবং গ্রামে কৃষিকাজ করে সংসার চালাতে না পেরে এবং অন্য কোনো আয়মূলক কাজ না পেয়ে গ্রাম থেকে মানুষ বস্তিতে আসতে বাধ্য হয়। বস্তিবাসীদের সবচে বড় সমস্যা তাদের আবাসন এবং কর্মসংস্থানের সংকট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কোনোটাই নগরের নিম্নআয়ের মানুষের জন্য নিশ্চিত হয়নি। নগরের বস্তিবাসী নিম্নআয়ের মানুষের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দরকার এবং এর প্রতিফলন এ বছর থেকেই হওয়া জরুরি। বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের বিশাল অংশকে উন্নয়নের সাথী না করে কোনোভাবেই এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

IMG_8757

গোলটেবিল বৈঠকে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে অংশগ্রহণকারীরা এই দাবিগুলো তুলে ধরেন: বস্তিবাসীদের জন্য সরকারীভাবে সহজ শর্তে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের সকল কাজের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বেতন কাঠামো ও উৎসব ভাতা নির্ধারণ করা ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, বস্তির শিশুদের জন্য অনুপাতিক হারে সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, যুবদের জন্য কর্মসংস্থানবান্ধব প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে, সকল বস্তিবাসীদের জন্য ভর্তুকী মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, বস্তিবাসীদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র বা কার্ডের ব্যবস্থা করা, নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ন্ত্রণে ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী যেমন; বয়স্ক, বিধবা, মাতৃত্বকালীন, প্রতিবন্ধি ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় তাদের যুক্ত করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষদের মালিকানায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। বিনামূল্যে তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

happy wheels 2

Comments