আগামী প্রজন্মের জন্য অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ সংরক্ষণ জরুরি
নেত্রকোনা থেকে সুমন তালুকদার
গতকাল মদন উপজেলার মদর ইউনিয়নের দক্ষিণ মদন গ্রামে নারী সংগঠনের উদ্যোগে এবং বারসিক’র সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হল হাওরাঞ্চলে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদের মেলা। মেলায় সংগঠনের সদস্য এবং ব্র্যাক পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মোট ১৪টি স্টলে অর্ধ শতাধিক কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদের প্রদর্শন করে। বিভিন্ন বয়সী স্থানীয় কৃষক-কৃষাণী, শিশু-কিশোরসহ ৯৫ জন মেলায় অংশগ্রহণ করে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
মেলার শুরুতে অংশগ্রহণকারীরা যে সকল অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ হাওরাঞ্চলের গ্রামের আনাচে-কানাচে থেকে সংগ্রহ করে খেয়ে থাকেন সেগুলো সংগ্রহ করে মাটিতে ট্রিপলের উপর সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট কাগজে নাম লিখে প্রদর্শন করা হয়। বারসিক’র মাঠ সহায়ক (কৃষি) বাবু সুমন তালুকদার এর সঞ্চালনায় মেলার আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নারী সংগঠনের সভাপতি মিসেস পাপিয়া আক্তার। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা করেন সংগঠনের সদস্য হিরা আক্তার, সদস্য আইরিন আক্তার, ব্র্যাক স্কুলের শিশু শিক্ষার্থী নেবি আক্তার, পল্লী চিকিৎসক মো. হাফিজ মিয়া এবং বারসিক’র সহযোগী সমন্বয়কারী শংকর ম্রং।
সভাপতি পাপিয়া আক্তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা যত উন্নত হচ্ছি ততই অচাষকৃত এসব খাদ্য উদ্ভিদগুলোকে অবহেলা করছি। অথচ এই খাদ্য উদ্ভিদগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কেননা এসব উদ্ভিদ যেহেতু মানুষ চাষ করে না এবং প্রাকৃতিকভাবেই এগুলো জন্মে তাই এগুলোতে কোন সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের ঔষধ হিসেবেও এগুলো কাজে লাগে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অচাষকৃত এসব খাদ্য উদ্ভিদের অনেকগুলোর সাথেই পরিচিত নয়। গ্রামের সকলের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব খাদ্য উদ্ভিদগুলো খেতে উৎসাহিত করা, বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের শিশু-কিশোরদেরকে এসব খাদ্য উদ্ভিদের সাথে পরিচিত করা ও নিরাপদ এসব খাদ্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যেই আমরা সাগঠনিকভাবে এই মেলা করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি আগামী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এসব অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে এগুলো নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখবে এবং এগুলো সংরক্ষণ করবে।’
সংগঠনের সদস্য হিরা আক্তার বলেন, ‘আজ অনেক ধরণের শাকসবজি মেলায় দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। মেলার স্টলে অনেক উদ্ভিদ প্রদর্শন করা হয়েছে যার অনেকগুলো আমি নিজেও চিনতাম না, কিভাবে খায় সেটাও জানতাম না। আজ মেলায় এসে সেগুলো চিনলাম এবং খাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কেও জানলাম। এসব উদ্ভিদ নিরাপদ, কোন ধরণের ক্ষতিকর কিছু নেই, স্বাস্থের জন্য এগুলো খুবই উপকারী। এগুলো নিয়মিত খেলে রোগবালাই কম হবে। আমি আশা করি আজ থেকে সকলেই নিজ নিজ বাড়ির চারপাশে জন্মানো এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণ করে নিয়মিত খাবেন এবং বাজারের শাক সবজি কম খাবেন।’
ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থী নেবি আক্তার তার বক্তব্যে বলে, ‘আমরা শিশুরা আজকের মেলায় অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের একটি স্টল দিয়েছি। আমরা যেসব উদ্ভিদগুলো আমাদের মা ও আত্মীয় স্বজনদেরকে আনাচে কানাচে থেকে সংগ্রহ করে রান্না করতে দেখি সেগুলোই স্টলে প্রদর্শন করেছি। মুরব্বীদের কাছে জিজ্ঞেস করেও কিছু কিছু খাদ্য উদ্ভিদ সংগ্রহ করেছি। মেলায় বড়রাও অনেক শাকসবজি নিয়ে এসেছেন, যেগুলো আমরা চিনতাম না সেগুলো আমরা চিনতে পেরেছি। আমরা এসব খাদ্য উদ্ভিদ নিয়মিত খাব এবং অন্যদেরও খাওয়ার পরামর্শ দিব।’
কৃষাণী আইরিন আক্তার বলেন, ‘আজকের মেলায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্টল দেয়ায় খুব ভালো লাগছে। শিশুরা এসব অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ সম্পর্কে ভালো জানে এটা জেনে আরও ভালো লাগছে। শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি খাদ্য উদ্ভিদ স্টলে এনেছে। এর মাধ্যমে শিশুরা এসব নিরাপদ খাদ্য উদ্ভিদ খেতে আগ্রহী হবে বলে আমি আশাবাদী।’
পল্লী চিকিৎসক হাফিজ মিয়া বলেন, ‘বারসিক ও নারী সংগঠনের এ ধরণের উদ্যোগ সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। যেসব অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ মেলায় প্রদর্শন করা হয়েছে তার সবগুলোই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এগুলো বিভিন্ন রোগবালাইয়ের ঔষধ হিসেবে কাজ করে এবং ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। এসব উদ্ভিদ নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস করলে আমরা অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকব এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হব।’
বারসিক এর সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ম্রং তার আলোচনায় সকলকে অনেক প্রজাতির খাদ্য উদ্ভিদ মেলায় প্রদর্শনের জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি মেলায় এসে হাওরাঞ্চলের অনেক অজানা অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বলে জানান। আগামী প্রজন্মের শিশু শিক্ষার্থীরা মেলায় মহা উৎসাহে স্টল দেয়ায় এবং অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ সম্পর্কে অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার সুযোগ করে দেয়ায় উদ্যোগক্তা নারী সংগঠনের প্রতি ও স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
অংশগ্রহণকারীরা অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের বিষয়টি শুধুমাত্র মেলার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে নিজেরা নিয়মিত এসব উদ্ভিদ সংগ্রহ করে খাওয়া এবং সকলের মুখে মুখে এর প্রচারণার মাধ্যমে সকলকে এসব উদ্ভিদ খেতে উদ্বুদ্ধ করে এগুলো সংরক্ষণের আশা ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠান শেষে মেলায় সবচেয়ে বেশি অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ প্রদর্শন ককরায় ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষাথীদের্র দলের হাতে প্রথম পুরষ্কার হিসেবে আ¤্রপলি ও থাই পেয়ারা চারা তুলে দেওয়া হয়। এছাড়াও দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকারীসহ সকল স্টলকে ফলের চারা উপহার প্রদান করা হয়।