জীবন যুদ্ধে জয়ী মনোয়ারা বেগম
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে বিউটি সরকার
জীবনে থাকে নানা ঘাতপ্রতিঘাত। জীবনে থাকে যুদ্ধ সংগ্রাম। তবে এই যুদ্ধে কেউ হয় জয়ী হয় কেউ আবার পরাজয়ের ডালি মাথায় নিয়ে ধুকে ধুকে মরে যায়। তবে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার গাড়াদিয়া গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৫৫) জীবনযুদ্ধে জয়ীদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও বেশি দুর আগাতে পারেননি তিনি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় নিজের অমতে বিয়ের পিড়েতে বসতে হয় তাঁকে। তবে এক সময় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। আবার মনোযোগ দেন পড়ালেখায়। কিন্তু জীবনযুদ্ধ এখানেও থেমে থাকেনি। সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর আবার তাঁর অমতে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তাকে। বিয়ের দিনই জানতে পারেন স্বামী একজন রাজাকার। যে কারণে বিয়ের দিনই স্বামী গ্রেফতার হয়।
মনোয়ারা বেগম ফিরে আসেন বাপের বাড়ি। আবার ভর্তি হন স্কুলে। নবম শ্রেণীতে উঠতে না উঠতেই বিয়ের পিড়িতে বসেন মনোয়ারা বেগম। এবার তার ভাগ্যে স্বামী নামের যে মানুষটি আসেন তিনি একজন মাতাল। তবে লেখাপড়ার প্রতি তার প্রবল ইচ্ছা থাকায় তাই বিয়ের পর লেখাপড়া করতে চেয়েছিলেন এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। মাতাল স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেও তিনি স্বামীর বাড়িতে থাকতে চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাঁর প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু এবারও ভাগ্য তার সাথে নির্মম পরিহাস করে। বিয়ের ৫ বছর পর স্বামী এ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। সন্তানকে নিয়ে পূনরায় বাবার বাড়ি গাড়াদিয়া গ্রামে চলে আসেন তিনি।
সন্তানের বয়স যখন ৪ তখন তাকে আবারো একই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাছেতের সাথে তাকে বিয়ে হয়। এ সংসারে তার ৩ সন্তানের জন্ম হয় । এ প্রসংঙ্গে মনোয়ারা বলেন, ‘আমরা নারী। আমরা পুরুষের খেলার পুতুল। আমাদের যেমনি নাচায় আমরা তেমনি নাচি।’ এবারের স্বামীর কোন সম্পত্তি না থাকায় অনেক অর্থ কষ্টে তার দিন কাটে। তবে তিনি ভেঙ্গে পড়েননি । টিউশনি করে এবং অন্যের জমি লিজ নিয়ে কৃষি কাজ করেন এবং পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু ও ছাগল পালন করেন। তার ছেলেও কৃষি কাজে তাকে সহায়তা করেন।
এভাবে পরিশ্রম করে আজ মনোয়ারা বেগম ভালো আছেন। বর্তমানে তাঁর বাৎসরিক আয় সত্তর হাজার টাকা। আয় দিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে ২ মেয়েকে এইচএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দেন এবং ছেলেদের লেখাপড়া করান। মনোয়ারা বেগম শুধু সংসারেই আবদ্ধ থাকেননি সামাজিক বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। কাউকে পরামর্শ দিয়ে, কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আবার কাউকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন । গ্রামের লোকেরা তার সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দু’বার ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেছেন।
এভাবে মনোয়ারাকে আর পেছনে ফেরাতে হয়নি। তিনি এখন গাড়াদিয়া গ্রামের একজন সফল নারী। এ প্রসঙ্গে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার জীবনে অনেক ঝড় গেছে তবুও ভেঙ্গে পড়িনি। আমি পরিবারের কারণে বেশি লেখাপড়া করতে না পারলেও আমার মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তারা এখন ভালো আছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ^াস ও পরিশ্রমের কারণে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছি।’