কোভিড-১৯:জীবিকা সংকটে ঋষি পরিবারগুলো

কোভিড-১৯:জীবিকা সংকটে ঋষি পরিবারগুলো

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

মহামারী করোনা দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরে অনেক পেশার মানুষ স্বাভাবিক জীব যাপনে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রায় প্রত্যেক মানুষই তাদের স্ব স্ব পেশার কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে তাদের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। করোনা সারা পৃথিবীর মানুষকে নানা বিপর্যয়ের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য হাজার রকমের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ চেষ্টার কোন শেষ নেই। কারণ জীবন-সময় কোনাটায় কারো জন্য অপেক্ষা করবে না। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর রূপ বদলাচ্ছে। এ বদলানোর সাথে তাল মিলিয়ে চলছে জীবনযাত্রা। মহামারী করোনা সারা পৃথিবীর মানুষ নানান সমস্যায় পড়েন। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যাগ্রস্ত নিন্ম আযের মানুষেরা। যাদের একদিন কাজ না করলে তাদের সংসার চলে না। তেমনি উপকূলীয় এলাকায় অসংখ্য পেশাজীবী মানুষ আছে যাদের খাদ্যের সন্ধ্যানে প্রতিনিয়ত বাইরে যেতে হয়।


তেমনই একটি পেশাজীবী জনগোষ্ঠী উপকুলীয় এলাকার ঋষি পরিবার। সাম্প্রতিক করোনাকালীন সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে উপকূলীয় এলাকার শ্যামনগর উপজেলার ইশ^রীপুর ইউনিয়নের ইশ^রীপুর গ্রামে কিছু ঋষি পরিবারের সাথে আলোচনা হয়। আলোচনায় তাদের প্রধান কাজ গুলো কি, বর্তমান যে করোনা পরিস্থিতিতে কেমন আছেন, তাদের বর্তমান জীবনযাত্রা কেমন চলছে ইত্যাদি বিষয় জানতে চাইলে তারা বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা তুলে ধরেন। আলোচনায় ঋষি পরিবারগুলো জানান, ‘তাদের ঋষিদের প্রধান কাজগুলো হলো বাঁশ দিয়ে নানান ধরনের উপকরণ তৈরি, বাশের তৈরি উপকরণগুলো নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ফেরি করা, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজ-বাজনা করা, জুতা সেলাই ও তৈরি, পালকি বাহক, মৃত ও জবাইকৃত গবাদি পশুর চামড়া ছেলা, চামড়া শুকানো, চামড়া দিয়ে তবলা ও ঢোল বানানো, চুল কাটা, ভ্যান চালানো, মুদি দোকান ইত্যাদি। এ কাজগুলো করে তারা ভালোই আছেন বলে জানান।


তারা আরো জানান, বর্তমান সময়কাল করোনা তাদের জীবনকে একটি কঠিন সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছ্।ে এখন নিজেদের পেশাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকায় ১৭টি ঋষি পরিবার আছে। নারী-পুরুষ সকলের প্রতিদিনকার কাজে উপরোক্ত কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্ততা ছিলো বাঁশ বেতের কাজ, যা সকলে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বাঁশ বেতের নানান উপকরণ তৈরির কাজ করে সময় পার করতেন তারা।এ বাঁশ দিয়ে চাটাই, ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চালন, মাছের ডালা, মাছ ধরার পলো, পানডালা, কাঁকড়ার খাচা, শিশুর দোলনা, ফুলদানি, কলমদানি, ভ্যানের ছাউনি, ধান রাখার ডোল, হাঁস-মুরগির খাচা, পাখা, গোলাসহ নানান ধরনের উপকরণ তৈরি করেন। সেগুলো খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে ভালো দাম পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নিজেদের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। করোনাকালীন সময় তাদের এখানকার অনেকের অনাহারেও দিন কাটাতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েকবার করে চাউল দেওয়া হয়েছে তাদের।


এই প্রসঙ্গে প্রবীণ নীলকান্ত দাস বলেন, ‘করোনার সময় কেমন ছিলাম সেসব দিনের কথা মনে করলে এখনো আতকে উঠি। আগে নানান সময় দুর্যোগ হয়েছে এলাকাতে কিন্তু এতোটা অসহায় কোনাদিন মনে হয়নি। এসময় যে নিজের আতœীয়স্বজনদের সাথে দেখাশুনা বন্ধ। কেউ কারো বাড়ি যেতে পারবেনা। বাড়িতে খাবার নেই। খাবারের জন্য কারো বাড়ি যেতে পারিনি। আমাদের বাঁশ বেতের কাজের কথা তো আর বলার নেই। এসময় আমাদের সমস্ত কাজ বন্ধ ছিলো। তারপরও ঋণপাতি করে ২-৪টি বাঁশ জোগাড় করে কিছু উপকরণ তৈরি করি। সেগুলো তৈরি করে তো আর বিক্রি করতে পারিনি। গ্রামে গ্রামে ফেরি করতে গেলেও তারা বাড়িতে ঢুকতে দিতো না। বলতো এসব আমাদের লাগবে না। এ কাজ বাদ দিয়ে যে যোন মজুরি দেবো ত্ওা হয় না। ছেলেরা ভ্যান চালায়, চুল কাটানোর কাজ করে সব তখন বন্ধ! কি যে এক বিভিষীকাময় জীবন পার করেছি তা একমাত্র ঈশ^ও ছাড়া আর কেউ জানেন না।’


আরেক প্রবীণ কুটেরাম দাস বলেন, ‘করোনা দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের দুর্দশা এখনো কাটেনি। আমাদের পেশার কাজ করছি ঠিকই কিন্তু তা বেচাকেনা খুবই কম হচ্ছে। আগে যেখানে দিনে ৫০০-১০০০ টাকা হতো এখন কোন দিন ২০০ টাকা হয়। আবার কোন কোন দিন এক টাকাও হয় না। নিজের সংসার চালানো যাচ্ছে না। কতোদিন আর এভাবে যেতে হবে।’


তরুণ ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি আমাদের গ্রামের এ ঋষিদের তৈরিকৃত জিনিসপত্র যেমন কিনতাম তেমনি বাইরের অন্য গ্রামের ঋষিদেরকে বাঁশবেতের জিনিস তৈরি করতে অডার দিতাম। এখন আমার দোকানে কয়েক হাজার টাকার পণ্য পড়ে আছে। বিক্রি করতে পারছি না। এখন পণ্যের তেমন দামও পাচ্ছি না। আমরা না পেলে কারিগর ঋষিদেরকে কিভাবে দেবো। এখন আর এসব পণ্য ভালো চলছে না।’
ঋষি নারী শিপ্্রা দাস বলেন, ‘আমরা নারীরা যেন আরো অসহায় হয়ে পড়েছি। সংসারে কোন আয় না হওয়াতে নানা ধরনের ঝগড়া বিবাদ সংসারে ছাড়াছেনা। ছেলে মেয়েদের আগে হাত খরচ দিতে পারতাম। আর এখন দিতে না পারায় তাদের সাথে মনোমালিন্য তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে সেখানে ছেলে মেয়েরা সময় কাটাতো। এখন যেন তারা পড়াশুনা ভুলে গেছে। খারাপ কাজে সাথে যুক্ত হচ্ছে। কিভাবে যে আমরা এই সময় পার করবো সেটা ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’


মহামারী করোনা প্রত্যেক পেশার মানুষকে নানান সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। তা থেকে বের হওযার জন্য নানানভাবে ছেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পেশাজীবী জনগোষ্ঠী। তেমনিভাবে ইশ^রীপুর গ্রামের ঋষি পরিবারগুলো তাদের হস্ত শিল্পের কাজের সাথে অন্য কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও হস্তশিল্পের কাজকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। দিন রাত পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করলেও তা বিক্রি করতে পারছেন না। আগের থেকে এখন অনেকে পেশা বদল করেছেন। কারণ এ ব্যবসা আর আগের মতো নেই। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঠিক সহায়তা ছাড়া হয়তোবা হস্তশিল্পের এ পেশা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

happy wheels 2

Comments