জনউন্নয়ন কেন্দ্র জননেতৃত্বের প্রতীক

নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
বাংলাদেশের কৃষকেরা মূলত প্রকৃতি থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা লাভ করেন, প্রকৃতিজ্ঞানে সমৃদ্ধ আমাদের প্রকৃতির সন্তানেরা, প্রকৃতি জ্ঞান অর্জন করেন, সেটা অন্যজনের মাঝে বিনিময় করেন, সহভাগিতা করেন, আদান প্রদান করেন, টিকিয়ে রেখেছেন কৃষি, কৃষি সংস্কৃতি, খাদ্যনিরাপত্তা, উন্নয়নের ধারা, স্থাায়ত্বশীল জীবনব্যবস্থা।

কৃষি অনুশীলন কেন্দ্রিক কৃষকের জ্ঞান আদান প্রদান, ও সম্প্রসারণে বারসিক নানাভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে সকল মানুষের কাছে এই জ্ঞান অভিজ্ঞতা পৌছে দেবার জন্য। ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দার উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক আ: জব্বার ২০২১ সালে নেত্রকোনা জেলার দূর্গাশ্রম গ্রামের বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠনের জাত গবেষণা কার্যক্রম দেখে ও ধানের জাত বিনিময়ের মাধ্যমে প্রথম নিজ গ্রামের কৃষকদের নিয়ে জাত গবেষণা ও সাধুপাড়া কৃষক সংগঠনের কাজ শুরু করেন। সকল মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সকলকে যুক্ত করে সাধুপাড়া কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হন ‘জনউন্নয়ন কেন্দ্র’। বীজের অধিকার, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পেশাবৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, পাখি রক্ষা, নার্সারি তৈরি, জৈবকৃষি চর্চা, পুষ্টিবাড়ি তৈরিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জনউন্নয়ন কেন্দ্র। এ অঞ্চলের মানুষকে কাজের সাথে যুক্ত করার জন্য কেন্দ্রের সদস্যরা আয়োজন করেন কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যমেলা, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যমেলা, পানি দিবস উদযাপন, ধানের জাতগবেষণা কার্যক্রম, ধানের জাতউন্নয়ন কার্যক্রম, বৃক্ষরোপণ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, কৃষিবিষয়ক মাসিক আলোচনা করে জনমানুষের নেতৃত্বে কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন।

জনউন্নয়ন কেন্দ্র তৈরির জন্য কৃষক আ: হেকিম দুই শতাংশ জমি দান করেছেন। গ্রামের কৃষকেরা কাঠ, বাঁশ, টিন, ইট, মাটি ও শ্রম দিয়ে গড়ে তোলেন এই স্বপ্নের জনউন্নয়নকেন্দ্র। তারাকান্দা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ২১টি গ্রাম ও ৭টি জনসংগঠন জনউন্নয়ন কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হয়েছে। ধানের জাত গবেষণার মাধ্যমে ‘হেকিম ধান’ এখন এই অঞ্চলের প্রায় ৩০০ কৃষক চাষ করছেন। কৃষককে মিডিয়ার সাথে যুক্ত করার জন্য চ্যানেল আই পরিচালক শাইখ সিরাজ একটি টিভি প্রদান করেন। কৃষকেরা প্রতিদিন এখানে আসেন টিভিতে অনুষ্ঠান দেখার জন্য। গ্রামেগুলোতে কৃষকের নেতৃত্বে জৈবকৃষিচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক আ: বারি, আ: হেকিম, দুলাল মিয়া, মোশারফ হোসেন, আ: লতিফ, ইসলাম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, আজিজুল হক কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে নিজে ব্যবহার ও অন্যের কাছে সম্প্রসারণ করছেন। এলাকায় মধু চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষক মোশারফ হোসেন, দুলাল মিয়া মধু উৎপাদন করছেন। জনউন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে তারাটি দাখিল মাদ্রাসা, খিচা উচচ বিদ্যালয়, সাধুপাড়া দাখিল মাদ্রাসা, সাধুপাড়া নগুয়া রাস্তা, মুদারপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফলজ, ঔষদি গাছ ও তালবীজ রোপণ করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় ভ‚মিকা রাখছে। পাখি রক্ষার জন্য গাছে গাছে কলসি ও সচেতনতামুলক সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন।

কৃষকেরা সংরক্ষণ করেন ধান, সবজি, মসল্লা ও তৈল জাতীয় শস্যের বীজ। কৃষক তার প্রয়োজনে নিয়ে যান বীজ, শর্ত অনুযায়ী চাষ করার পর সমপরিমাণ বীজ ফেরত দিয়ে যান আবার এই জনউন্নয়ন কেন্দ্রে। এলাকার ৪ টি যুব সংগঠন, দুটি নারীসংগঠন যুক্ত হয়েছে জনউন্নয়ন কেন্দ্রের সাথে। যুবরা করোনাকালিন সময়ে পথচারী, নি¤œআয়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী, জরুরি খাদ্য সহায়তা নিয়ে।

জনউন্নয়ন কেন্দ্র সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এখানে সকল পেশার মানুষ আসবে শিখবে, শিখাবে, জানবে, জানাবে, শিক্ষা দিবে, শিক্ষা নিবে, মতামত, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। এসব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কখনই পয়সা খরচ করে জানতে ও শিখতে হয়না। এসব জ্ঞান অভিজ্ঞতা বংশ পরম্পরায় স্থানীয় এলাকায় বিরাজমান থাকে। গ্রামনির্ভর মানুষের এই অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, গ্রাম থেকে গ্রামে, বিনিময় করার জন্য সাধুপাড়া জনউন্নয়ন কেন্দ্র বিশেষভাবে ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। গ্রামনির্ভর, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষেরা তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই গড়ে তুলবেন এক আলাদা স্থায়িত্বশীল, পারস্পরিক নির্ভরশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ জীবনমুখী শিক্ষা পরিসর, যা সাধারণ মানুষের আন্তঃনির্ভরশীল ও মুক্তির পথ বের করে দেবে।

happy wheels 2

Comments