দুর্যোগ কাটিয়ে এখন কৃষকরা আশার আলো দেখছেন
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
চাকরিজীবিরা মাস গেলে বেতন পায়, ব্যবসায়ীরা লাভের অংশ ঘরে তোলে। কিন্তু কৃষকদের একমাত্র ভরসা হচ্ছে মাঠের ফসল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে একজন কৃষক নিজের জমিতে চাষ করেন। এই ফসলে তাঁদের সারা বছরের খোরাক, পরিবারের চাহিদা পূরণ, আরো কত কি করতে হয়। কিন্তু সেই ফসল যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় তবে কৃষকদের সব স্বপ্ন এক নিমিষেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
আমাদের দেশের কৃষি অনেকাংশে প্রকৃতিনির্ভর। কৃষিকাজে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ যেমন বৃষ্টি, রোদ অতি প্রয়োজনীয় তেমনি এগুলোর অতিরিক্ততাও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চলতি বছরের রোরো মৌসুমে কৃষকরা প্রকৃতির ‘অতি’ প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নেত্রকোণা অঞ্চলের কৃষকগণ চাষাবাদের ক্ষেত্রে নিজস্ব চাহিদাকে মাথায় রেখে ফসল চাষ করেন। তাঁরা কিছু ফসল চাষ করেন যেগুলো আগাম ফলন দেয়। এক্ষেত্রে ধান ফসলের কথা বলা হচ্ছে। বি আর-২৮ জাতের ধান চাষ করলে আগাম ফলন পাওয়া যায়। আর বি আর-২৯ বা অন্যান্য স্থানীয় জাতের ধান একটু দেরিতে পাকে। ফলে সেই সুযোগে আগাম ফসল ঘরে তোলা যায়।
প্রতি বছরের মতো এবারও কৃষকরা তাঁদের নিয়মানুযায়ী ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু বি আর-২৮ ধান পাকার সময় ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। যে কারণে ধানে চিটার পরিমাণ বেশি হয়। ১০ শতাংশ জমিতে কৃষকরা যেখানে ৭/৮ মণ ধান উৎপাদন করতে পারতেন সেখানে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩/৪ মণ।
জিরাশাইল, বি আর-২৯ ইত্যাদি জাতের ধান কাটার আগ মুহূর্তে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এর ফলস্বরূপ জমিতে পানি জমে এবং ধান গাছ হেলে পানিতে পড়ে যায়। অতিবৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন ধান কাটতে সমস্যা অন্যদিকে ধান শুকানো যাচ্ছেনা।
জমিতে পানি জমে থাকা ও গাছ হেলে পড়ার কারণে ধান কাটার জন্য শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছিল। যদিওবা শ্রমিক পাওয়া যেতো তাও আবার উচ্চ মূল্যের পারিশ্রমিক দিয়ে ধান কাটাতে হয়েছে। চড়া মূল্যে না হয় ধান কাটানো হলো, এবার ধান বিক্রির পালা। ভেজা ধান নিয়ে কৃষকরা আবার বিপাকে পড়েন। রোদ নেই, ধান শুকানো যাচ্ছেনা। ধানের পাশাপাশি খড়ও ভিজে নষ্ট হয়েছে। সুযোগ বুঝে ধান কেনার পাইকরগণও কৃষকদের সাথে অসহযোগিতা করেছেন। রোদ না থাকায় কৃষকদের ভেজা ধান বিক্রি করতে হয়েছে। পাইকারগণ ভেজা ধান অতি কম মূল্যে (মণ প্রতি ৬ শ’ টাকা) কিনেছেন। কোনো সময় কেনার কথা দিয়েও আসেননি। আবার ভেজা ধান কিনে কৃষকদের কাছে ফেরৎ পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে।
আতকাপাড়া গ্রামের কৃষক সুপন মিয়ার ৮০শতাংশ জমিতে অন্যান্য বছর প্রায় ৯০মণের মতো ধান উৎপাদিত হয়। এবছর তিনি মাত্র ৫১ মণ ধান পেয়েছেন। এই জমির ধান কাটাতে শ্রমিক মূল্য বাবদ খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তাছাড়া শ্রমিকদেরকে দুই বেলা খাবারও দিতে হয়েছে। কাটা ধানের গোছা বাড়িতে নিয়ে আসতে আরো ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে।
এই ৫১ মণ ধান বিক্রির হিসাব আসে ৩০ হাজার ৬শ’ টাকা। কিন্তু শুধুমাত্র ধান কাটাতে তাঁর খরচ হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। চাষের ক্ষেত্রে যা খরচ হয়েছে, তা নাহয় বাদই দিলাম। সুপন মিয়ার মতো অনেক কৃষক অতিকম মূল্যে তাঁদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শুধুমাত্র অতিবৃষ্টির কারণে। এছাড়া কত পরিমাণ খড় যে রাস্তায় পড়ে পঁচে গেছে তার হিসেব নেই।
প্রকৃতি সব সময় তার নিজের খেয়ালে চলে। অতিবৃষ্টি শেষে এখন আকাশ পরিষ্কার করে ঝিকমিক রোদ উঠেছে। প্রকৃতির মতো কৃষকদের মনের আকাশও আজ পরিষ্কার। পরিস্থিতি পাল্টেছে। তাঁরা ধান, খড় শুকাতে পারছেন। বিক্রি করতে পারছেন ভালো দামে। এখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ টাকা থেকে ১২শ’ টাকা দরে। কোনো কোনো কৃষক আশা করছের দাম আরো বাড়তে পারে। তাই তারা কিছু পরিমাণ ধান শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। পরবর্তী সময়ে বেশি দামে বিক্রি করবেন।
হাওড় বা ভাটি এলাকায় গরুর খড়ের অভাব দেখা দেয়। তাই সেই এলাকার কৃষকগণ এখানে আসেন খড় কিনতে। নিজেদের পালিত গরুর খাবারের যোগান সংরক্ষণ করার পর বাকি খড় কৃষকরা বিক্রি করে দেন। ধানের পাশাপাশি খড় শুকিয়েও সংরক্ষণ করছেন তাঁরা।
এখন কৃষকের গোলায় ধান উঠে গেছে। নিজের খাবারের পরিমাণ ধান সংরক্ষণ করে বাকিটুকু বিক্রি করছেন। ধানের মূল্যের উর্ধ্বগতি থাকাতে তাঁদের হতাশাও কেটেছে। নিজেদের সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে এবং জীবন জীবিকার তাগিদে যে পরিমাণ পরিশ্রম করে তাঁরা কৃষিকাজ করেন, সে পরিমান ফসলের মূল্য পেলে পরিশ্রমের পরও স্বস্তি নেমে আসে তাঁদের জীবনে।
কখনো বৃষ্টি আবার কখনো রোদ। শীত, গরম আর কুয়াশায় চলে প্রকৃতির খেলা। অনিয়মের প্রাকৃতিক রুপকে পুস্তকের ভাষায় জলবাযু পরিবর্তন বলে আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই জানেন না জলবায়ু পরিবর্তন কি জিনিস। তাঁরা বোঝেন নির্দিষ্ট সময়ে রোদ বা বৃষ্টি যদি হয় তাহলে তাঁদের চাষাবাদের জন্য উপকারী। প্রকৃতির নিয়মেই চাষাবাদ করতে তাঁরা অভ্যস্ত। সময় মতো ফসল ঘরে তোলা আর উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করতে পারলেই তাঁদের পরিশ্রম সার্থক হবে। দুশ্চিন্তা আর হয়রানি দূর হয়ে হাসি ফুটবে অমলিন চেহারায়।