বরেন্দ্র অঞ্চলে অনাবৃষ্টি ও তীব্র দাপদাহ: বৃষ্টির জন্য আচার-অনুষ্ঠান ও সম্প্রীতির প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান
ভরা বর্ষা মৌসুমেও বরেন্দ্র অঞ্চলে চলছে স্মরণকালের অনাবৃষ্টি ও ভয়াবহ তীব্র তাপদহ। রাজশাহী আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে- সাধারণত: বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীতে তাপমাত্রার বিগত আট বছর অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এপ্রিলে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা আগের এক দশকের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ। বর্ষাকালে ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা কখনো বেশি তাপমাত্রা অনুভুত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রবীণরা জানান বর্ষাকালে এরকম বেশি তাপমাত্রা বা অনাবৃষ্টি দেখা যায়নি কখনো। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান বলেন, রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছরই তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলে আরো স্পষ্ট হচ্ছে। বর্ষার এই ভরা মৌসুমেও এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টি না হাবার কারণে কৃষক সঠিক সময়ে ফসল রোপণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে অতিরিক্ত তাপদহের কারণে জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। তাই বৃষ্টির প্রত্যাশায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। বৃষ্টির জন্য নানা আচার- অনুষ্ঠান, লোকাচার পালন করা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চল ঘুরে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টির জন্য লোকাচার বিষয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি করেছেনে বারসিক’র গবেষক মো: শহিদুল ইসলাম।
ভূমিকা
একটানা তাপদহ খরায় মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচিড়। শহর কিংবা গ্রাম-সর্বত্রই তীব্র গরমের প্রাদুর্ভাব। আষাঢ়ে বৃষ্টি হবে সেই আশায় শ্রাবণ এসে গেলো। বৃষ্টির কোন খোঁজ নেই। আকাশজুড়ে নীলাভ সাদা মেঘে। বৃষ্টি হওয়ার কোন চিহ্ন নেই। তানোর মন্ডুমালা মাহালি আদিবাসী পাড়ার গ্রাম প্রধান মোড়ল জোহান মাডির্ (৬৫) বলেন, ‘আষাঢ় মাসে এরকম অধিক তাপমাত্রা আর অনাবৃষ্টির কবলে কখনোই পড়েনি বরেন্দ্র অঞ্চল।” স্মরণকালের ভয়াবহ অনাবৃষ্টির মধ্যে দিন পার করছে বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। কৃষক অপেক্ষা করছে ধান রোপণের, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অসময়ে ধান রোপণে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবেনা, কৃষকের মাথায় সেই চিন্তাও ঘোরপাক খাচ্ছে। অন্যদিকে শ্রমিক কাজহীনভাবে দিন পার করছে ঘরে, আর্থিকভাবে সংকটে পড়ছে। তানোরের মিশন পাড়ার আলবিকুস হে¤্রম (৪৫) বলেন- “ঘরে যেটুকু সংগ্রহ (খাদ্য) ছিলো তাও তো শেষ, কাজ না করলে কি খাব। ধার দেনা বেড়ে যাচ্ছে।” এদিকে তীব্র গরমে তানোরের পিরানপুকুর গ্রামের আঙ্গুরি বেগমের (৩৫) তিনটি ছাগল মারা গেছে। একই কারণে মাহালী পাড়ার সুজলা মার্ডিও (৪০) একটি দামড়া (ষাঢ়) বড় গরু মারা গেছে। অনাবৃষ্টির কারণে বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীর তাপমাত্রা আরো তীব্রতর থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সকল ধর্ম বর্ণ ও পেশার মানুষ চেয়ে আছেন আকাশের দিকে, কখন আকাশ থেকে পানি নামবে, কখন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির জন্য সকল ধর্ম বর্ণ পেশার মানুষ তাঁদের আদি সংস্কৃতি ও নানা লোকাচার পালন করছেন। প্রার্থনা করছেন বৃষ্টির জন্য। তাঁদের একটাই চাওয়া প্রকৃতি কখন তাদের ভিজিয়ে দিবে, পানি দিবে, শীতল করবে এ খরা মাটি। বৃষ্টির জন্য পালন করছেন আদি পূর্ব পূরুষের থেকে চলে আসা নানা লোকাচার।
বৃষ্টির জন্য লোকাচার তথ্য সংগ্রহের প্রেক্ষাপট
কৃষি প্রধান বরেন্দ্র অঞ্চলেও নানা লোকজ বা রিচুয়ালগুলো সেই আদি যুগ থেকে প্রচলিত আছে। বিভিন্ন দুর্যোগে, দুর্ভোগে, সংকটে মানুষ এক হয়ে লোকজ অনুষ্ঠান, লোকাচার পালনের মধ্যে দিয়ে সংকট উত্তোরণ পেতে চায়। চলমান সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে অনাবৃষ্টি ও তীব্র খরা থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য নানা লোকাচারগুলো পালন করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষ মাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেদিকগুলো তুলে ধরার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। মূলত: সংকটে দুর্যোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামের মানুষ কিভাবে তাঁর সংকট কাটিয়ে উঠতে এক হয়ে লড়াই করে, একসাথে সংকট সমাধানে বাঁচতে চায়, সেই দিকটিই দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। একই সাথে লোকাচারগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পর্য়বেক্ষণ প্রতিবেদনটি করতে বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলার গ্রামের মানুষের লোকাচারগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিবেদনের সহায়তা করেছেন সেই কমিউনিটির তরুণসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠী। নওগাঁর নেয়ামতপুরের সবুর আহমেদ, নাচোলের ব্রজেন্দ্র নাথ, তানোরের উত্তম কুমার সরকার, আয়শা তাবাচ্ছুম, রিনা টুডু কিছু লোকাচারের প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করেছেন। একই সাথে লেখক নিজে উপস্থিত থেকে লোকাচারগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। মানুষের অনুভূতি এবং সংকটগুলো প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয়েছে। যেহেতু বিগত সময়গুলোতে কখনোই এরকম বর্ষাকালে এই অঞ্চলের এরকম দীর্ঘ সময়ে অনাবৃষ্টির কবলে পড়েনি, আর এরকম কোন তীব্র তাপদাহ হয়নি, তাই বিষয়গুলো সম্পার্কে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকাচার, লোকজ সংস্কৃতির দিকগুলো জানাই প্রধান কারণ।
বৃষ্টির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলে নানা লোকাচার ও সম্প্রীতির বন্ধন
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে আদিকাল থেকেই কৃষি এবং দুর্যোগ কেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠান তথা লোকাচার পালন হয়ে আসছে। আধুনিক এই যুগেও মানুষ তাঁর পূর্ব পুরুষের লোকারগুলো এখনো পালন করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষাকালেও চলছে ভয়াবহতম তীব্র তাপদহ ও অনাবৃষ্টি। ভরা বর্ষায় এরকম অনাবৃষ্টির কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্টী পড়েছেন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। বৃষ্টির অপক্ষোয় প্রহর গুণছেন। বৃষ্টি আসলেই তাদের এই দুর্যোগ কেটে যাবে বলে মনে করেন। বৃষ্টির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠী তাঁদের আদি ও পূর্বপুরুষের প্রচলিত লোকাচার সংস্কৃতিগুলো পালন করছেন। আর এসব লোকাচারগুলো পালনে থাকেনা কোন ধর্ম বর্ণ ও পেশার পার্থক্য। সবাই মিলে মিশে একটাই চাওয়া, তা হলো বৃষ্টি। এসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটি এলাকার মানুষ এক জায়গায় হচ্ছে, একসাথে লোকাচারগুলো পালন করছে। যা সৌহার্দ ও সম্প্রীতির এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত। লোকজ আনুষ্ঠিকতা বাংলাদেশের তথা বাঙালির সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে। চলমান সময়ে এসব লোকাচার পালনের দৃষ্টান্তগুলো তাই বলে। বৃষ্টির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ জেলার
লোকাচারগুলো তুলে ধরা হলো:
বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে তথা সকল ধর্ম বর্ণ মেিলমিশে এক হয়ে বৃষ্টির কামনা করা
আদি যুগ থেকে পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া যে লোকজ সংস্কৃতি উত্তর পুরুষের প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তা জানা গেলো রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহর গ্রামের ব্যাঙ্গের বিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী খ্রিষ্টানসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর প্রায় বারশ’ পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। অনাবৃষ্টি এবং খরায় যখন পুড়ছে তাদের জমির ফসল, নানা সমস্যা পড়ছে। আষাঢ় মাস পেরোলেও বৃষ্টির দেখা নেই। ঠিক এই সংকটে সবাই এক হয়ে বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করেন। সেই বিয়েতে গ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একসাথে একইভাবে প্রকৃতির কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছেন। নেচে গেয়ে বৃষ্টির জন্য আবাহন করেছেন। একটি উৎসবমূখর পরিবেশ গ্রামজুড়ে। সবাই উৎসাহে যোগ দেয় তাতে। মহা ধুমধামে হিন্দুরীতি অনুসারে বিয়ের জন্য তৈরী করে ছায়ামন্ডুপ, পুষ্পমাল্য, গায়ে হলুদ, আর্শীবাদের ধান-দূর্বা, খাওয়ার আয়োজনসহ সব ধরনের ব্যবস্থাই ছিলো ব্যাঙের বিয়েতে। কোন রকম ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে পালিত হয় এই ব্যাঙের বিয়ে। বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিই ছিলো প্রাধান্য। ব্যাঙের বিয়েতে বর ব্যাঙের মা বাবা হন মুসলমান পরিবার থেকে আবার মেয়ে ব্যাঙের বর হন একজন সনাতন পরিবার থেকে। এ যেন গভীর আত্মিক এক মহামিলন। যেখানে কোন ভেদাভেদ নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য গ্রামের সকল বাড়ি থেকে তরুণ তরুণীরা চাল ডাল তুলেন, চাঁদা তুলেন। তা দিয়ে আপ্যায়নের আয়োজনও চোখে পড়ার মতো। ব্যাঙের বিয়ের মধ্যে দিয়ে তারা সবাই বৃষ্টির জন্য আবাহন করেন। তাঁদের বিশ^াস ব্যাঙ পানিতে থাকে, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি হবে। আকাশ থেকে বৃষ্টি হবে।
আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ের মধ্যে বৃষ্টির জন্য রিচুয়াল
যখন অনাবৃষ্টি এবং খরা হয় তখন আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাড়ি ঘর, খইলানে (উঠোন) গবর দিয়ে নুড়ি (লেপে) দিতো। এবং বাড়ির চার পাশে গোবর পানি ছিটিয়ে দিতো। তাঁদের ধারনা গোবর অনেক পবিত্র। তাই গবর ছিটালে পবিত্রতা বাড়বে এবং বৃষ্টি নামবে। অন্যদিকে গ্রামের কিশোর কিশোরীরা বিল থেকে ব্যাঙ ধরে এনে বিয়ের আয়োজন করতো। এই বিয়ের জন্য ঘরে ঘরে চাল তুলতো, সবজি সংগ্রহ করতো। ব্যাঙ এর বিয়ের আয়োজনের দিন ধুমধাম করে খাওয়া হতো। গ্রামটির প্রবীণ নারী আগাতা কিস্কু (৮৫) বলেন, ‘আগে চৈত্র বৈশিাখ মাসে পানি না হলে পানির জন্য আমরা ব্যাঙ এর বিয়ের আয়োজন করতাম। এখনতো ব্যাঙ নেই, ব্যাঙ কমে গেছে আবার ব্যাঙ এর বিয়ের আয়োজনও কমে গেছে। তবে এবার আমরা বৃষ্টির জন্য বাড়ি ঘরে, খৈলানে গোবর নুড়ি দিয়েছি যাতে বৃষ্টি আসে।’
ইস্তেখারার নামাজ প্রার্থনা
পর্যবেক্ষণে জানা যায় আদিযুগ থেকে প্রকৃতির কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন মানুষ। নানা পেশার, নানা ধর্মে নানাভাবে প্রচলিত আছে সমাজে। মুসলমানদের মধ্যে কয়েক গ্রামের মানুষ এক জায়গায় হয়ে বৃষ্টির জন্য এসতেস্কাফার নামাজ আদায় করেন। ইস্তেখার নামাজ পড়ে যখন জমিন শুকিয়ে যায় অথবা অনাবৃষ্টি শুরু, জলাধারের জল শুকিয়ে যায়, নদী পুকুর শুকিয়ে যায়। এই নামাজ সুর্যোদয়ের পর বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মতো ঈদের নামাজের মতো করে কয়েক গ্রামের মানুষ একজায়গায় এসে নামাজ পড়ে। পর্যবেক্ষণে জানা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলে এসব প্রার্থনায় মুসলমান ছাড়াও নানা ধর্মের লোকজনকেও অংশগ্রহণ করে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। রাজশাহীর তানোর উপজেলায় সাম্প্রতি বৃষ্টিুর জন্য কয়েক গ্রামের মানুষ এক হয়ে এই এস্তেখার নামাজ আদায় করেন। সবাই উপরে হাত তুলে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন।
হুদমা গান
নওগাঁ অঞ্চলে এসময় আদিবাসীদের মধ্যে হুদমা গানের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জন্য আবাহন করতো। জানা যায় হুদমা হলো মেঘের দেবতা। কৃষক রমনী রাত্রী বেলায় গান গেয়ে নেচে গেয়ে কৃষি জমিতে পানি ঢালে, পানি ছিটিয়ে থাকে। তাদের ধারণা এতে করে বৃষ্টি আসবে। নওগাঁ অঞ্চলে অতীতে এই লোকাচার বেশি পালন করলেও এখন তা কম দেখা যায় বলে জানান সবুর আহমেদ (২৫)।
সনাতন ধর্মে বৃষ্টির জন্য ব্রত পালন
লোকাচারের হাজার হাজার বছর থেকে ধর্মী বিশ^াস এবং সম্প্রীতিগুলোও স্থান পেয়ে আসছে। সনাতন ধর্মে পুণ্যি পুকুর ব্রত, বসু ধারা ব্রত পালনের কথা জানা যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামের ব্রজেন্দ্র নাথ (৩৮) বলেন, যখন চরম অনাবৃষ্টি এবং বৃষ্টির জন্য হাহাকার উঠে যায়, তখন আমরা বৃষ্টির জন্য ব্রত পালন করে থাকি। প্রার্থনা করি বৃষ্টির জন্য। বৈশাখ মাসে এবং গ্রীস্মের সময় যাতে পুকুর জলশুন্য না হয়, গাছ পালা না মরে, প্রকৃতির প্রতিটি জীব যাতে ভালো থাকে, ফসল যেন ভালো হয়, এর জন্য আমরা পুণ্যি পুকুর ব্রত পালন করি।’ সাধারণত কুমারি মেয়েরা এই ব্রত পালন করলেও এখন আর কুমারিরা তেমন করেনা বলে জানা যায়। তবে বৃষ্টির জন্য বয়স্করা ব্রত পালন করেন। ঠিক তেমনি বসু ধারা ব্রত পালন করা হয় বৃষ্টির জন্য। বসু অর্থ পৃথিবী আর ধারা অর্থ ক্রামাগত বৃষ্টির ধারা জলের ধারা। এ ছাড়াও নারী পুরুষরা বৃষ্টির জন্য একসাথে ইন্দ্র দেবতার পুজার আয়োজনসহ সমবেতভাবে প্রার্থনা করে। যেখানে গ্রামের নারী পুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করেন।
এ ছাড়াও বৃষ্টির জন্য নানা লোকাচারের কথা জানা গেছে। সেগুলো আর পালন হয়না বলেই অনেকে বলেছেন। যেমন: গ্রামের কুমারি নারীর গায়ে কাঁদা মেখে, কলসিতে পানি নিয়ে গ্রামে ছিটিয়ে ছিটিয়ে গান গেয়ে গ্রাম ঘুরতো। যাকে কাঁদা মাখানো বলা হতো। আবার নারীরা কুলাতে ধানসহ ফুল ফল নিয়ে সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং বৃষ্টির জন্য গান গায়। আল্লাহ মেঘ দে পানি দে। যাকে কুলা নামানো বলে থাকে। সনাতন ধর্মের মধ্যে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বৃষ্টি দেবতার তুষ্টির জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো বৃষ্টির জন্য।
উপসংহার
অনাবৃষ্টি থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় অনেক বেশি লোকাচার পালন হতো। কালের বিবর্তনে সেগুলো অনেকটাই এখন আর পালন করা হয়না। পর্যবেক্ষণ এলাকায় প্রবীণদের কাছ থেকে বিভিন্ন লোকাচারের কথা জানলেও তা এখন আর পালন করা হয়না বলে জানা যায়। তবে ব্যাঙের বিয়ে এবং ইস্তেখারার প্রার্থনা বা নামাজ এই লোকাচারটি অনেক বেশি পালন হতে দেখা যায়। চলমান সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে দীর্ঘ সময়ে অনাবৃষ্টির কারণে তাব্র তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ভরা বর্ষা মৌসুমে যখন ধান রোপন করবে কিন্তু বৃষ্টি না থাকার কারণে ধান রোপণ করতে পারছেন না। আবার অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে জমির ফসল পুড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে গবাদি পশু পাখিও মারা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টির জন্য এই অঞ্চলের মানুষ নানা লোকাচার পাণ করে। যাতে বৃষ্টি আছে। এই লোকাচারগুলো একদিকে যেমন মানুষের বিশ^াস দৃঢ় করে অন্যদিকে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি সৃষ্টিতে অবদান রাখে।