‘ইচ্ছাশক্তি থাকলে নিজের ভাগ্য উন্নয়ন করা যায়’-রেহানা পারভীন
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে চম্পা মল্লিক
রেহানা পারভীন (৩৩)। স্বামী : আফজাল হোসেন (৩৭) ও একটি মাত্র মেয়ে লামিসা (১০)। স্বামীর– ১ বিঘা চিংড়ি ঘেরের উপরই চলতো তাদের সংসার। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে একমাত্র আয়ের উৎস সেই চিংড়ি ঘেরটিও ক্ষতিগ্রস্ততার সন্মূখীন হতে হতো তাদের। অন্যদিকে বাজারের উপর ছিলো সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীলতা। কোনরকম চলতো তাদের সংসারটি। সকলের চাহিদা ঠিকমতো পূরণ না হওয়ায় নিজেদের মধ্যে প্রায়ই অশান্তি হতো।
একসময় বারসিকের এক কর্মীর সাথে রেহানা পারভীনের যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে তিনি বারসিকের বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভা, অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরসহ নানা ধরনের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এ ধরনের আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের মাধ্যমে তার ভিতরে একটি বিশ^াস জন্মে যে, অন্য নারীদের মতো তিনিও কিছু করতে পারবেন। আর তিনি কিছু করলে তাঁর স্বামীকে অনেক সহযোগিতা করা হবে। সংসার ও ভালোভাবে চলবে। এটাই ভেবে প্রথমে তিনি বারসিক থেকে ২০১৯ সালে কিছু সবজি বীজ সহযোগিতা নেন। এই সবজি বীজ তিনি তার বসতভিটার ৫ শতক জায়গাতে খুব ভালোভাবে লাগাতে পেরেছিলেন। এর আগে গ্রামের অন্যদের মতো তার ও ধারণা ছিলো, মাটি লবণ হয়ে গেছে এখন আর সবজি হবেনা। কিন্তু বাস্তবে সুন্দর সবজি দেখে তার মনটা ভরে গেলো। স্বাদের দিক থেকে বাজারের সবজি আর বাড়ির সবজির ভিন্নতা তিনি তখনই বুঝেছিলেন।
এরপর থেকে তিনি কোন না কোন সবজি বারোমাস লাগান এবং এভাবে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন। এছাড়াও নানা ধরনের সবজি বীজ ও সংরক্ষণ করতে শেখেন বারসিকের পরামর্শে। ধীরে ধীরে তিনি অন্য নারীদেরকেও বুঝাতে থাকেন তার কার্যক্রম সম্পর্কে এবং এভাবে তার পরিচিতি ও বাড়তে থাকে নিজ গ্রামে।
পরবর্তিতে ২০১৯ সালের মধ্যে তিনি তার মতো কিছু আগ্রহী ও উদ্যোগী নারীদেরকে নিয়ে একটি নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। সকল নারীদের সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তুলতে বারসিক থেকে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে ৩০টি সঞ্চয় বই সহায়তা করা হয়। এরপর থেকে নারীরা প্রতিমাসে একত্রিত হন এবং সঞ্চয় কার্যক্রম শুরু করেন। ধীরে ধীরে সংগঠনে অনেক নারী যুক্ত হতে থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে আলোচনা করতে শুরু করেন। অনেক নারী এক জায়গায় বসে আলোচনা করতে প্রয়োজন হয় একটি বসার উপকরণ। তাই ২০২২ সালে সংগঠনের সকল নারীদের বসার উপকরণ হিসিবে একটি ত্রিপল ও সহায়তা করা হয়। প্রতিমাসের মাসিক মিটিং এর জন্যে নারীরা এটি ব্যবহার করেন।
এরপর রেহানা পারভীন আয়বর্ধনমূলক কাজের জন্য বাড়িতে একটি পোল্ট্রি ফার্ম করতে চাইলে বারসিক থেকে তাকে স্থানীয় জাতের মুরগি পালন এবং পোল্ট্রি পালন এ দুটির সুবিধা অসুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেয়। উভয় দিক ভেবে তিনি স্থানীয় জাতের মুরগি পালনের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি বারসিক কর্মীকে জানান, তার এলাকায় স্থানীয় জাতের হাঁস-মুরগির ডিম এবং হাঁস মুরগির মূল্য অধিক থাকার কারণে তার পক্ষে বেশি আকারে পোষা হয়তো সম্ভব হবেনা। এরপর বারসিক থেকে তাকে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য একটি ইনকিউবেটর মেশিন সহায়তা করা হয় পাশাপাশি সকল নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এই পর্যন্ত তিনি তিনবার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়েছেন। চার হাজার টাকার মুরগি বিক্রি করেছেন এবং বর্তমানে তার বাড়িতে ৭১টি স্থানীয় জাতের মোরগ ও মুরগি রয়েছে। তিনি বারসিক থেকে স্থানীয় জাতের মুরগি পালন ও পরিচর্যা বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ চান। তিনি তার এই কাজটিকে আরো ও প্রসারিত করতে চান। তার ইচ্ছা তিনি তার বাড়িতে এক ভাগে ডিমের মুরগি এবং অন্যদিকে মাংস হিসেবে বিক্রির জন্য মুরগি রাখবেন। যাতে ডিম দুর থেকে সংগ্রহ না করতে হয়। এছাড়া ও তিনি তার সংগঠনের সকল নারীদেরকে তার ইনকিউবেটর মেশিন দিয়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটাতে সহযোগীতা করবেন এমনকি কম মুল্যে শুধু সংগঠনের নারীদের কছে ডিম বাচ্চা বিক্রি করবেন।