বীজ সংকট মোকবেলায় ভূমিকা রাখছে তারানগর কমিউনিটি বীজ ব্যাংক

মুন্না রংদী ও গুঞ্জন রেমা
নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের তারানগর গ্রামে আদিবসাী কেন্দ্রিক গড়ে ্ওঠে একটি সংগঠন নাম মিকরাকা। জনসংগঠনের সদস্যরা প্রায় সবাই প্রবীণ তবে নতুন করে কিছু নবীণ সদস্যও যুক্ত হচ্ছেন এই সংগঠনে। সংগঠনটির সদস্যদের উদ্যোগে বিগত তিনবছরে (২০১৬/২০১৭/২০১৮) ধানজাত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন গ্রামটিতে। যেখানে প্রায় ২০টি ধানজাত নিয়ে এলাকা উপযোগী ধানজাত বাছাই করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর ফলে এলাকায় কিছু ধানজাত বৃদ্ধি পায় যা এখানকার কৃষকেরা এখন পর্যন্ত চাষ করে আসছেন। যেমন, বিশালী বিন্নি, মালশিরা । ফলন ভালো হওয়ার কারণে হেমার ও রতিশাইল ধানও চাষ করতেন এ গ্রামের কিছু কৃষক। একটা সময় হেমার, রতিশাইল ধান চাষ বন্ধ হয়ে যায় বীজ সংগ্রহে না থাকার কারণে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, ‘ধানবীজ তো আসলে সবাই নিজ প্রয়োজনে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্র তো আর নেই যে কিনা এটি সংরক্ষণ করবে।’ হেমার ও রতিশাইল ধান দুটি হারানোর পর সংগঠনের সদস্যরা উদ্যোগ নেন বীজ ঘর স্থাপনের। তারপর ২০২২ সালে মিকরাকা সংগঠনের উদ্যোগে ও বারসিক এর সহযোগিতায় গড়ে ওঠে কমিউনিটি বীজ ব্যাংক। বীজ ব্যাংকটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।


কমিউনিটি বীজ ব্যাংক স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো এলাকায় চাষকৃত শাকসব্জি, শস্যফসল ও ধানের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিনিময় করা। কৃষকেরা নিজেরা বীজ সংগ্রহ না করার কারণে বেশির ভাগ মানুষ বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অনেক সময় বাজার থেকে বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন। অনেক আদি ধান ও সব্জির জাত এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে দেখা এখন কোম্পানিনির্ভর হয়ে গেছে এখানকার কৃষক। কৃষকের বীজ কৃষকেরাই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করবে প্রয়োজনে বিনিময় করবেন। কৃষকেরা বীজের জন্য বাজার নির্ভরশীল হবেন না। বীজ ব্যাংকটি উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে এমনটাই বলছিলেন এ সংগঠনের সভাপতি সাবিনা রংদী। এ বীজ ঘরে বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি হলো এ সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ বাড়িতে চাষ করা শাকসব্জির থেকে বীজ সংগ্রহ করে এই বীজ ঘরে সংরক্ষণ করবেন এবং যাদেরকে বীজ সহযোগিতা করা হয়েছিল বিগত মৌসুমগুলোতে তাদের কাছ থেকেও বীজ সংগ্রহ করা হয়। যখন বীজ সহযোগিতা করা হয় তখনই বলে দেওয়া হয়। যে পরিমাণ বীজ সহযোগিতা করা হচ্ছে সেই একই পরিমাণ বীজ যাতে ফসল করার পর বীজ ঘরে জমা দেওয়া হয় তা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কমিউনিটি বীজ ব্যাংকে বর্তমানে ২৫ জাতের ধান বীজ সংরক্ষণ করা আছে। যেমন- ডিএস-৩, লোহাজং, সোনারী পাইজাম, রহমত, খেকশিয়াল, আতব, কার্তিক শাইল, সাগর ফণা, রাধুনী পাগল, বাদশা ভোগ, জেসমিন, কাতারী ভোগ, রতিশাইল, গন্ধরাজ, তুলসীমালা, চিনিগুড়া, চিনিশাইল, মালশিরা, গুটিস্বর্ণা, মালতী বিন্নি, কার্তিক বিন্নি, গেংগেং বিন্নি, আগুইন্যা বিন্নি, মশুরী, ব্রিডিং( মথি ঘাগ্রা এর ব্রিডিং করা ধান)। সব্জি বীজের মধ্যে রয়েছে পুইশাক, কলমিশাক, শসা, ধুন্দল, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পাটশাক, টমেটো, ডাটাশাক, লালশাক, ডিম বেগুন, শিংনাথ বেগুন, চুখাই, চিক কাইক্যা শিম, সাদা কাইক্যা শিম, আশ্বিনা শিম, খায়রুল সুন্দরী শিম, পুডি শিম, সাদা পুডি শিম, আমপাতা শিম, কাতলা ও কতিউড়ি শিমের বীজ, ৫ জাতের মরিচ বীজ ইত্যাদি।


তারানগর কমিউনিটি বীজ ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ৭টি গ্রামে ৯৭টি পরিবারকে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন জাতের শাসসব্জি ও ধানের বীজ সহযোগিতা করা হয়েছে। যেসব গ্রামের মানুষেরা এ বীজঘর থেকে বীজ সহযোগিতা পেয়েছেন সেই গ্রামগুলো হলো: তারানগর, শিবপুর, গৌরিপুর, লেঙ্গুরা, ফুলবাড়ী, কালাপানি, গোড়াগাও প্রভৃতি। এ বছর আমন মৌসুমে ১১ জন কৃষকের মাঝে ১০টি জাতের ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। যেমন -গন্ধরাজ, চিনিশাইল, মালশিরা, রহমত, মালতী বিন্নি, সাগরফণা, খেকশিয়াল, পুরা বিন্নি, রতিশাইল, চিনিগুড়া।


এই প্রসঙ্গে লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ভাইস চেয়ারম্যান জুলেখা খাতুন বলেন, ‘এই বীজ ঘর/বীজব্যাংক শুধু এখানেই নয় বরং প্রত্যেকটি গ্রামেই এমন বীজ ঘর থাকা প্রয়োজন। কারণ এই তারানগরের বীজ ব্যাংক থাকাতে যে কোন সময় এখানকার কৃষকগণ তাদের প্রয়োজন অনুসারে বীজ নিয়ে রোপণ করতে পারছেন। আমিও এখান থেকে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন শাক সব্জির বীজ নিয়ে রোপণ করি।’


তারানগর কমিউনিটি বীজ ব্যাংক স্থাপনে এখাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন, যা মথি ঘাগ্রার ভাষায় বুঝা যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের আগের যেসব ধানগুলো আমরা চাষ করতাম এখন সেসব ধানজাতগুলো হারিয়ে ফেলেছি। এই যে বীজ ব্যাংক আমরা স্থাপন করতে পেরেছি আমাদের এ তারানগর গ্রামে। এখন আশা করি আর বীজের জন্য আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে না।’

happy wheels 2

Comments