সরিষা চাষে সফলতা পাচ্ছেন বড় বিলের কৃষকরা
রাজশাহী থেকে সুলতানা খাতুন ও অমৃত সরকার
ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেকে তুলা, তার অর্ধেকে ধান, বিনা চাষে পান। কৃষিকাজে খনার এই বচনটি অনেক বেশি জনপ্রিয় কৃষিকাজে। এর সরল অর্থ হলো মূলা চাষে ভালো ফলন পেতে ১৬টি চাষ দেওয়া ভালো। তেমনই তুলায় ৮টি আর ধানে ৪টি চাষ দিলে ভালো ফলন মেলে। কিন্তু পান চাষ হয় বিনা চাষে। তবে রাজশাহীর পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিলনেপালপাড়া গ্রামের বড় বিলে কৃষকরা বিনা চাষে সরিষা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এই বিলে বিলনেপালপাড়া, সুন্দলপুর, বিলধর্মপুর, তেঁতুলিয়াডাঙ্গা এই ৪টি গ্রামের মোট ৭৯ জন কৃষক ১৩৪ বিঘা জমিতে এবার আমন ধান চাষ শেষে বিনাচাষে সরিষা বুনে এ সফলতা পেয়েছেন।
যেভাবে শুরু
বারসিক রাজশাহীর পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নে বিলনেপালপাড়া গ্রামে কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। কাজ শুরুর পর ২০১৮ সালে বিলনেপালপাড়া জনগোষ্ঠির চাহিদা ও এলাকার সমস্যা বিবেচনায় বড় বিলে পানিসহনশীল ৮টি ধানজাত নিয়ে একটি প্রায়োগিক কৃষি গবেষণা পরিচালিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিলের একটি বড় অংশ পানি জমে থাকার কারণে আমন ধানের চাষ হতো না। আবার পানি নেমে যেতে দেরি হতো বিধায় সে জমিতে বোরো ধান ছাড়া আর ফসল হতো না। সেই গবেষণা থেকে চেংগুড় জাতের ধানটি কৃষকরা পছন্দ করেন। এখন বিলের একবারে নিচু জমিগুলোতে চেংগুড় ধান চাষ হয়। পাশাপাশি বিলনেপালপাড়া চাষী ক্লাবের কৃষকদের ২০১৮ সালের দিকে রবি মৌসুমে রবিশস্য হিসেবে সরিষা, মসুর, খেসারি বীজ সহযোগিতা করা হয়।
বিলনেপালপাড়া চাষী ক্লাবের সভার মাধ্যমে বারসিক জানতে পাওে, বড় বিলে জমিতে চাষ না দিয়ে সরিষা চাষের সম্ভাবনা আছে। কারণ আমন ধান কেটে নেওয়ার পরও জমির উপযুক্ত আদ্রতা (জোঁ) আসতে অনেক বেশি সময় লাগে। আবার সরিষাও খুব কম সময়ে চাষ হয়। প্রথমবার মাত্র ৫ জন কৃষক আমন ধান কেটে নিয়ে মাত্র ৫ বিঘা জমিতে সরিষা ছিটিয়ে দিয়ে আসেন। এ পদ্ধতিতে প্রথমবার সরিষা চাষ করেন বিলনেপালপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আজিজুল ইসলাম (৫০)। তিনি বলেন, “আমরা এর আগে সরিষা চাষ করেছি যেবার পানি তারারতারি নেমে যেত সেবার বা অন্য জমিতে কিন্তু সেবার একবারে ভেজা জমিতে সরিষা বুনে দিয়ে আসি পরে পরিচর্যার করে বিঘায় ৩.৫ মণ হারে ফলন আসে, যা আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়েছিলো। কারণ আবার সঠিক সময় বিলের জমিতে বোর ধানের চাষ করতে পেরেছিলাম।
কার্যক্রমটি দিন দিন জনপ্রিয় হয় ও ছড়িয়ে পড়ে
প্রথমবার ৫জন কৃষকের সফলতা দেখে আস্তে আস্তে এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হতে থাকে। বাড়তে থাকে বড় বিলে বিনা চাষে সরিষার আবাদ। এবার বড় বিলের আশেপাশের ৪টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেল কৃষকরা কোন কোন কৃষক সরিষা মাড়াই করছেন পাশাপাশি বিলে চাষকৃত প্রায় সকল সরিষাই পরিপক্ক হয়ে গেছে। বারসিক থেকে এবার সুন্দলপুর ও বিলনেপাল পাড়া মিলিয়ে ৪ জন প্রান্তিক কৃষককে এ পদ্ধতি চাষের জন্য সরাসরি সরিষা বীজ সহযোগিতা করা হলেও উল্লেখ্য গ্রামগুলোর মধ্য ৭৯ জন কৃষক মোট ১৩৪ বিঘা জমিতে বিনা চাষে সরিষা চাষ করেছেন। সুন্দলপুর গ্রামে কৃষক মোঃ মিজানুর রহমান (৪৮) সরিষা মাড়াই করছিলেন কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, “আমি আমন ধান পরিপক্ক হওয়ার পরপরই ভেজা জমিতে সরিষা বুনে দিয়ে আসি। এরপর ধান কাটার পর একটু পরিচর্যা করে বিঘাপ্রতি ৩ মণ হারে ফলন পেয়েছি। গতবার ৩ মণ হারে ফলন পেয়েছিলাম।’ এ বিষয়ে কথা হয় বিলনেপালপাড়া চাষী ক্লাবের সদস্য মোঃ সাবাহান আলীর (৪২) সাথে। তিনি বলেন, “বারসিক থেকে এই পদ্ধতি শেখার পর আমি প্রতিবারই এই পদ্ধতিতে সরিষার চাষ করছি। বিনা চাষে সরিষার চাষ করলে মাত্র ১০০০-১৫০০ টাকা চাষ খরচ হয় এবং সরিষার ফলন ও দাম হিসেবে ১০-১২ হাজার টাকা লাভ হয়। আবার সময়মতো বোরো ধানের চাষ হয়। জমি বেশি চাষ না করার কারণ জমিও ভালো থাকে।’
বারসিক ও বিলনেপালপাড়া গ্রামের জনগোষ্ঠির সমন্বয়ে যৌথ উদ্যোগটি দারুণ সফলতা পেয়েছে। বিনাচাষে সরিষা আবাদের ধারণাটি একবারে নতুন না হলেও বড় বিল পাড়ারের কৃষকদের জন্য এটা ছিলো একবারে নতুন ধারণা, যা কৃষকরা দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা সমাধান করে কৃষকদের জন্য স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন বয়ে এনেছে।