দ্বন্দ্ব ও উন্নয়ন (Conflict and Development)
ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার
উন্নয়নকর্মী হিসেবে একটা জিনিস বারবার ভাবিয়েছে। আমরা বারবার ‘না ঘর কা না ঘটকা’ অবস্থানে থাকি। এড়িয়ে চলি সকল ধরনের ঝামেলাÑদ্বন্দ্ব। কিন্তু দ্বন্দ্ব ছাড়া যেখানে আমাদের জীবনের কোন কাজই সম্ভব নয়। সেখানে সমাজ পরিবর্তন বা উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব। খাদ্য গ্রহণ থেকে ত্যাগ, চলাফেরা, বিনোদন সব কিছুর সাথে দ্বন্দ্ব বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। সুতরাং উন্নয়ন বা সমাজ এর ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যদি সমাজে বা প্রকৃতিতে বিদ্যমান অপরিহার্য দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে কী আদৌও সম্ভব!
দ্বন্দ এবং উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করার আগে দ্বন্দ্ব কে নিয়ে একটু নাড়াচড়া করা জরুরি। প্রথমেই জেনে নেই দ্বন্দ্ব এর সংজ্ঞা এবং ধরণ সমূহ।
Conflict শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয় ‘দ্বন্দ্ব’ শব্দটি। দ্বন্দ্ব বলতে বুঝায় সংঘাত, ঝগড়া, বিবাদ, যুদ্ধ বা শত্রুতা; দ্বিধা বা সংশয়। দ্বন্দ্ব হলো বৈপরীত্য বা Contradiction। দ্বন্দ্ব একটি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে গতিশীলতা দান করে। সবকিছু নিয়ত গতিশীল, তা সে অণু-পরমাণুই হোক কিংবা গ্রহ-নক্ষত্র। আমরা আমাদের সীমিত খালি চোখে তা সবসময় অনুধাবন করি না। এবং এই গতিশীলতার মধ্যে বৈপরীত্য কাজ করে। আর এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সবকিছুর বিকাশ হয়। সে জন্যই কোন কিছু বিকাশের কিংবা পরিবর্তনের পথ কখনো মসৃণ হয় না। ধীরে ধীরে জড়ো হওয়া ছোট ছোট পরিবর্তন হঠাৎ করে বড় পরিবর্তনের সূচনা করে।
দ্বন্দ্ব বলতে বোঝায় একটি দলের এক বা একাধিক সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য, বিরোধ, সংঘর্ষ প্রভৃতি বিশ্বাস বা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে দ্বন্দ্ব দু’টি দলের মধ্যেও হতে পারে। দ্বন্দ্ব যখন একই দলের মধ্যে সংঘঠিত হয় তখন তাকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে। আর যদি দ্ইু বা ততোধিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় তখন সেটিকে আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব বলা হয়। দ্বন্দ্বকে দেখা হয় পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব কোন স্থায়ী ও অনড় নয়। যদি দ্বন্দ্ব সমঝোতায় আসে তাহলে দলের সদস্যরা পুনরায় আগের কাজগুলো করতে থাকে। সমঝোতা না হলে নতুন একটি বিষয় বা ঘটনার সূচনা হয়।
মানুষ এবং দ্বন্দ্ব (সামাজিক দ্বন্দ্ব)
মানুষের সৃষ্টি থেকেই দ্বন্দ্বের শুরু। কখনো সে নিজের সাথে। কখনো বা অন্যের সাথে। আমাদের চারপাশের প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দ্বন্দ্বের নানারূপ দেখতে পাই। কিছু সাধারণ দ্বন্দে¦র রূপ হচ্ছে-গোত্র-গোত্র দ্বন্দ্ব, জাতিগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, মতাদৈর্শ্বিক দ্বন্দ্ব (বামপন্থী বনাম ডানপন্থী), মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব (গার্মেন্টস কর্মী এবং মালিক)। কখনো কখনো এই দ্বন্দ্বের কারণ হয় বস্তুগত উপাদান নিয়ে। যেমন: প্রাকৃতিক সম্পদ ভূমি নিয়ে চরাঞ্চলগুলো প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। আবার সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়েও দ্বন্দ্বের সংখ্যা কম নয়। উদাহরণ হিসেবে ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব, সম্মান-প্রতিপত্তি নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, প্রভৃতি।
দ্বন্দ্বের বৈচিত্রতা
দ্বন্দ্বকে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। ধারণা করা হয়, শুধুমাত্র মানুষে মানুষেই দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতির প্রায় অধিকাংশ বিষয়ের সাথে দ্বন্দ্ব অপরিহার্য একটি বিষয়। মানুষে মানুষে যেমন দ্বন্দ্ব থাকে তেমনি দ্বন্দ্ব হয় মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে। আবার প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের সাথে দ্বন্দ্বের প্রকৃতি এবং পদ্ধতি এক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে যে ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল, মানুষ এবং উদ্ভিদের সাথে ভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। আবার ভৌত উপাদান মাটি, পানি, বায়ুর সাথে ভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আমরা যদি বায়ুকে দূষিত করে ফেলি আমাদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাহলে একসময় ওই বায়ু আর আমাদের জীবন প্রদায়ী না হয়ে হুমকির কারণ হয়ে যায়। তখন আমরাই আবার নানাভাবে সেই বায়ুকে নিজেদের জীবন উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করি।
মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জৈবিক এবং ভৌত পরিবেশের একটি উপাদানের সাথে অন্যটির নানা ধরনের দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। আবার একটি প্রাণীর সাথে উদ্ভিদের যে দ্বন্দ্ব, সেটি উদ্ভিদে-উদ্ভিদে বা প্রাণীতে-প্রাণীতে ভিন্ন হয়। আবার একই উদ্ভিদ বা প্রাণীর মধ্যে প্রজাতি ভেদেও দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থকতে পারে। সবশেষে পরিবেশের ভৌত বা জৈবিক উপাদানের সাথে জড় উপাদানের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। আবার জড় বস্তুর মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। যেমন: প্রযুক্তি হিসেবে লাঙল এর ব্যবহার কমে যায় যখন কৃষি ক্ষেত্রে পাওয়ার ট্রিলার এর আর্বিভাব হয়। অন্যদিকে জড় বস্তুর ব্যবহারের সাপেক্ষে পরিবেশের জৈবিক উপাদানের সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়। পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে ভূমি কর্ষণের ফলে মাটিস্থ কেঁচোসহ অন্যান্য উপকারী কীট-পতঙ্গ নষ্ট হচ্ছে। আবার কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বায়ু দূষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বন্দ্ব এবং উন্নয়ন
দ্বন্দ্বকে যদি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। আর উন্নয়ন যদি আর্থ-সামাজিক নির্দেশকের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়। তাহলে দ্বন্দ্ব উন্নয়নেরই একটি অংশ। আবার কোন একটি জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বগুলো না বুঝতে পারলে সেই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। আর এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিবেচনা না করাই বুঝি কাংখিত উন্নয়নের পথে আমাদের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ধরা যাক, কোন একটি প্রান্তিক এবং সুবিধা বঞ্চিত(!) একটি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলো। কিন্তু, এখানে ওই জনগোষ্ঠীর সাথে আর যে সমস্ত জনগোষ্ঠীর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে তারা উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে থাকে। তাহলে প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো কী আদৌও কার্যকর হবে?
অন্যদিকে উন্নয়নে যদি মানুষ-মানুষ ছাড়া প্রকৃতির অন্যান্য দ্বন্দ্ব গুলোকে বিবেচনা না করা হয়; তাহলে সেটি টেকসই উন্নয়ন হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বরেন্দ্র এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করার জন্য ধান চাষভিত্তিক প্রযুক্তির অবতারণা এই প্রতিবেশীয় ধান এবং অন্যান্য প্রজাতি কিংবা পানি এবং মাটির যে সম্পর্ক সেটি ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছে। কিংবা ধান চাষ বৃদ্ধির ফলে ঐ এলাকার অচাষকৃত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে-সেটিও বিবেচনা করা জরুরি। যদি এই বিষয়গুলো বিবেচনা না করা হয় তবে সেটি তাৎক্ষণিক সুফল বয়ে আনলেও দীর্ঘমেয়াদে নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
উদাহরণ হিসেবে জেন্ডার উন্নয়ন বলতে এখনো পর্যন্ত প্রধানতম ধারণা হচ্ছে জেন্ডার মানেই নারী। যার সকল কিছুতে নারী সম্পৃক্ত থাকবে। অনেকটা এভাবে বলা যায়, নারীদের জন্য নারীদের দ্বারা পরিচালিত এবং বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রম। এখানে শুধু পুরুষরা বাইরে থাকে তাই নয়; অনেকাংশে পুরুষকে জেন্ডার সমতার পরিপন্থি বা অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, অন্যান্য বিষয়ের মতো নারী পুরুষের সম্পর্ক চিরকালই দ্বন্দ্বিক। তাই জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ এর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিবেচনা করাটা আত্যাবশ্যকীয়।
পরিবেশ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ ধ্বংসের জন্য যে সমস্ত স্টেকহোল্ডার দায়ী তাদেরকে অনেকটা ভিলেন হিসেবে বিবেচনা করে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়। যেমন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কখনোই কলকারখানার মালিক কিংবা এর সাথে জড়িত মানুষদের নিয়ে সেনসিটাইজেশন করার কোন উদ্যোগ আজও নজরে আসেনি। কিংবা শিশুশ্রম বা গৃহস্থলীতে শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করার সময় যদি যে বাড়িতে শিশু কাজ করে তাদেরকে যদি বিবেচনায় না আনি তাহলে কাংখিত উন্নয়ন বা পরিবর্তন যাই বলি না কোন কোনটাই অর্জিত হবে কী?
পরিশেষে বলতে চাই, উন্নয়নকর্মী বা সমাজকর্মী যাই হই না কেন- আমাদের সমাজে এবং প্রকৃতিতে বিদ্যমান দ্বন্দ্বসমূহকে বুঝতে হবে এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আর আমরা যখন দ্বন্দ্বকে স্বাভাবিক এবং সার্বজনীন হিসেবে বিবেচনা করতে পারবো তখনই সমাজকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবো।
নোট: ছবিগুলো ইন্টানেট এর মুক্ত সোর্স থেকে সংগৃহীত।