একটি যুব সংগঠনের ব্যতিক্রমী সামাজিক উদ্যোগ
কেন্দুয়া, নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমূল ইউনিয়নের অর্ন্তভূক্ত গ্রাম নোয়াদিয়া। গ্রামের ৮০ ভাগ পরিবারই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। তাদের আয়ের মূল উৎসও কৃষি। নোয়াদিয়া গ্রামে দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার একটি হাইস্কুল অন্যটি প্রাইমারী স্কুল। গ্রামের অধিকাংশ ছেলে মেয়েরাই এ দু’টি স্কুলে পড়াশুনা করে।
গ্রামের কিছু উদ্যোগী যুবক মিলে যুব সমাজকে মাদকমুক্ত রাখা, গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করা ও এলাকার ছোট ছোট উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য ‘ধান-শালিক-নদী-হাওর’ নামে একটি যুব সংগঠন গড়ে তোলে। সংগঠনটি এক বছর যাবত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ (খাতা, কলম) সহায়তা, স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঔষধি গাছে পরিচিতি, হাসির আড্ডা, মাদকের কুফল ও বাল্যবিবাহ সম্পর্কে যুবকদের সচেতন করে চলেছে। সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার ফলে গ্রামের যুব সমাজ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হচ্ছে, তারা মাদক থেকে নিজেদের বিরত রাখতে সক্ষম হচ্ছে, বাল্যবিবাহ বন্ধে সংগঠনের সদস্যরা এলাকায় জোর প্রচারণা চালিয়ে অভিভাবক ও যুব সমাজকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সুবিধার্থে সংগঠনটি গ্রামে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে, যেখানে ৪০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরণের বই সংরক্ষণ করা হয়েছে। নিজ গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী আরো পাঁচটি গ্রামের যুব ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই লাইব্রেরিতে এসে জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ লাভ করছে। এই লাইব্রেরি সমাজে যুবদের সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
সংগঠনের উদ্যোগে সম্প্রতি নোয়াদিয়া গ্রামের পাশে ‘দরিয়া’ বিলটি পরিচ্ছন্ন ও কচুরিপানামুক্ত করা হয়েছে। প্রায় চারশত কাঠা জমির এই দরিয়া বিলে উৎপাদিত মাছের উপর নির্ভরশীল ছিল গ্রামের প্রায় তিনশত পরিবার। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই বিল থেকে সারাবছর মাছ শিকার করতেন, গ্রামবাসীদেরকে বাজারের মাছের উপর নির্ভর করতে হতো না। বিলে প্রায় সব ধরনের মাছ পাওয়া যেত। এই বিলে উৎপাদিত ধান ও মাছ দিয়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু কচুরিপানায় বিলটি ভরাট হওয়া, দলীয়করণ, সামাজিক সংঘাত, হট্টগোল আর প্রতিহিংসার কবলে পড়ার কারণে এ বিলটি আজ বিলুপ্তপ্রায়, যা এলাকার যুবদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দরিয়া বিলটি সংস্কার ও পুনঃখননের জন্য সংগঠনের ১৫ জন যুবক গ্রামের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের সাথে আলোচনায় বিলের কচুরিপানা পরিষ্কার করে সেটি পুনঃখনন করার জন্য স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা কামনা করে। স্থানীয় সরকার থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে কচুরিপানা পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়। বিলটি কচুরিপানামুক্ত হওয়ায় বিলে আবার প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় জাতের মাছ জন্মাবে বলে সংগঠনের যুব ও গ্রামের মানুষ আশা করছেন। বিলটির কচুরিপানামুক্ত করতে যুব সংগঠনের উদ্যোগটি গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মল্লিক তালুকদার দরিয়া বিলটি পুনঃখননের জন্য খুব শিগগিরই উর্ধতন সরকারি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে সক্ষম হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দরিয়া বিলটি পুনঃখননে যুব সংগঠনের উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামের প্রায় তিনশত পরিবার বিলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছ থেকে আমিষের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে এবং বিলের প্রাকৃতিক পানি ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে স্থানীয় জাতের অনেক মাছের প্রজাতি।
নোয়াদিয়া গ্রামের ‘ধান-শালিক-নদী-হাওর’ যুব সংগঠনের ন্যায় দেশের প্রতিটি গ্রামের যুব সমাজ সংগঠিত হয়ে এমন সামাজিক উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করলে গোটা দেশের প্রতিটি গ্রামীণ সমাজ একদিন সামাজিক অনাচার থেকে মুক্ত হবে, শান্তি বিরাজ করবে প্রতিটি সমাজে, বৃদ্ধি পাবে পারস্পারিক সহযোগিতা, নির্ভরশীলতা এবং বৃদ্ধি পাবে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ।