মানিকগঞ্জে মাঠের পর মাঠে সোনালি ধানের ঢেউ কিন্তু নেই কাটার শ্রমিক
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
মানিকগঞ্জে এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষিশ্রমিকের তীব্র সঙ্কট এবং উচ্চ মূল্যের কারণে কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছে। তার ওপর যেকোনো মুহূর্তে শিলা বৃষ্টিতে তাদের স্বপ্নের ধানের ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে বলেও তারা শঙ্কিত।
এবার জেলায় ধানের ভালো উৎপাদন হয়েছে কিন্তু বর্তমানে ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই করার জন্য পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। খোরাকি কামলা ( প্রতি দিন ৩ বার খেয়ে) ৬৫০ টাকা খেকে ৭০০ টাকা রোজ। প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১১০০ টাকা আর বর্তমান বাজার মূল্য ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা।
অপরদিকে, সরকারিভাবে ধানক্রয় কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। যদিও সরকারি প্রতিকেজি ধান ক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা কেজি। সে হিসেবে সরকারিভাবে প্রতিমণ ধান ক্রয় করা হবে ৯৬০ টাকায়। বেশির ভাগ সময় কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি এ ক্রয় করা হয় না। ফলে দালাল-ফরিয়ারাই লাভবান হয়। অনেক কৃষকেরই অভিযোগ ইতিপূর্বে তারা সরকারি মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
জেলার সদর উপজেলার ভাটভাউর গ্রামের ধানচাষী মো. আমীর আলী বলেন, “কামলার (শ্রমিকের) দাম বেশি । আর বর্তমানে যে বাজার দর তাতে আমার চালান উঠবে না।” শিবালয় উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের চাষী মো. লুৎফর রহমান বলেন, “আমি ৫৪ শতাংশ জমি অর্থাৎ দুই বিঘা জমি এক বছরের জন্যে লিজ নিয়েছি, জমির মালিককে আমার ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। দুই পাখিতে আমার সব দিয়ে খরচ হয়েছে ৪৭ হাজার টাকা। তাতে বর্তমান মূল্যে আমার প্রায় ৯ হাজার টাকা লোকসান যাবে।”
ভাটভাউর গ্রামের ধানচাষী মো. শাহিদ আলী বলেন, “ধানকাটা শ্রমিকের যে দাম তাতে শুধু কাটার জন্যেই অর্ধেক ধান তাদের দিয়ে দিতে হয়। যদি সরকার থেকে আধুনিক ধান কাটা ও মারাইয়ের মেশিন সরবরাহ করা হতো, তাহলে আমরা আবাদ করে একটু শান্তি পেতাম। সারা চকভরা পাকা ধান কিন্তু ধানকাটার (শ্রমিকের) অভাবে আমরা ধান ঘরে তুলতে পারছি না।”
শিবালয় উপজেলার কোনাবাড়ী গ্রামের মো. সমেজ উদ্দিন বলেন, “চকের পর চক পাকা ধান। আল্লাহ না করুন যদি কোন শিলা বৃষ্টি বা ঝড় হয় তাহলে আমদের সারাবছরের সব আয় শেষ।” সরকারিভাবে ধান কাটার মেশিন সরবরাহের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার ব্যবস্থা নিলে আমরা সরকার নির্ধারিত টাকা পরিশোধ করবো।”
সরকারি ধান-চাল ক্রয় কার্যক্রম-সংক্রান্ত ব্যাপারে জেলা ধান-চাল ক্রয় কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক নাজমুছ সাদাত সেলিম বলেন, “এ বছর জেলায় ২৯১ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখনো ধান সংগ্রহের কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।” জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আলিমুজ্জাম মিয়া বলেন, “এ বছর জেলায় ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৪ টন। এ হিসাবে এবার জেলার ধান উৎপাদন হবে এক লাখ ৭৬ হাজার টন।” তিনি বলেন, “জেলায় এখনো ৭০ শতাংশ ধান মাঠে রয়েছে। শুধু এক বিঘা ধান কাটার জন্যেই কৃষকদের খরচ হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এটা আসলেই খুবই কষ্টকর ব্যাপার। তবে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে ধান কাটাই, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী করার কম্বাইন্ড সারভেস্টার মেশিন কৃষকদের মাঝে অর্ধেক দামে প্রদান করা হবে।”
তিনি জানান, প্রতিটি মেশিন ৭ লাখ টাকা করে। কিন্তু সরকার সাড়ে ৩ লাখ টাকার তা কৃষকদের মাঝে প্রদান করবে। এ মেশিনের মাধ্যমে দিনে ১০০ একর জমির ধান কাটা সম্ভব। এতে প্রতি বিঘার কৃষকের খরচ হবে মাত্র ২০০ টাকা। এটা তো সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়? সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের কাছ থেকে খরচ নিয়ে এ মেশিন দেয়া সম্ভব কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “জেলায় বর্তমানে দুটি মেশিন বেসরকারিভাবে চলছে। আর সরকারিভাবে একটি চলছে। তবে এটি দিয়ে শুধু সরকারি প্রদর্শনী প্রকল্পে ধান কাটা হচ্ছে। তবে আগামী প্রত্যেকটি উপজেলায় একটি করে মেশিনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হবে।”
কৃষি শ্রমিকের অভাবে স্কুল-কলেজ –মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্র, চাকরিজীবী, পীরের মুরিদানসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ধান ঘরে তুলতে মাঠে নেমে পড়েছেন। জেলার ধান চাষীদের দাবি, কৃষি বিভাগের মাধ্যমে ন্যায্য খরচ নিয়ে তাদের কম্বাইন্ড সারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।