ওদের জীবনেও এসেছিলো ঈদ, আসেনি কেবল আনন্দ
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। মাসজুড়ে কেনাকাটা। নতুন জামা কাপড়। ঈদেও দিন সেমাই, পোলাও, গোশতো, ফিরনী, কোরমা আরো কত মুখরোচক খাবারের সমারোহ। এ আনন্দ আরো বর্ধিত করতে অনেকেই দেশ ছাড়িয়ে ভিন্ন দেশে দেশে উদযাপন করেন ঈদ। ঈদ সাধারণত বৃহৎ আনন্দ উৎসব হলেও সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে ঈদ আসে, আসে না কেবল আনন্দ। তাদের কাছে ধরা দেয় না ঈদের বর্ণিল রংচ্ছটা।
৮/৯ বছরের টুটুল জানেই না কে তাদের বাবা-মা। নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই ওর। পথই ওর ঠিকানা। দিনভর পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, কারো ফুট ফরমাস খাটে, কেউ খেতে দেয় আবার অনেক দিন ভাগ্যে সামান্য খাবারটুকুও জোটেনা। রাতে ঘুমায় যাত্রী ছাউনী কিংবা টার্মিনালে। ঈদের দিন বিকেলে কথা হয় মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে। একটি বাস ধোয়া মুছার কাজ করছে ২০ টাকার বিনিময়ে। এরপর কোথায় যাবে, কি খাবে জানা নেই তার। এমন টুটুলের মতো অগণিত সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশুদের জীবনে আসে ঈদ। কেবল আসে না ঈদের নতুন জামা-কাপড়, আসে না কোন আনন্দ। অন্যান্য দিনও যেমন; ঈদের দিনও তেমনই, নেই কোনো পার্থক্য, নেই কোনো আয়োজন। পরম মমতায় ওদের মাথায় কেউ বুলিয়ে দেয় না হাত। ওরা জানে না ঈদ কী। ঈদে নতুন জামা পরেছে কি না জানতে চাইলে বলে ‘আমগো ঈদ নেই। নতুন জামা দিবো কে?’ গত বছর একজনে একটি জামা দিয়েছিল। এবার কেউ দেয়নি।
রোগাক্রান্ত শীর্ণ শরীরের ইদ্দিছ (১০) জানে শুধু ওর নাম। ছোট্ট বেলায় মায়ের কাছে শুনেছে ওদের বাড়ি জামালপুরে। নদী ভাঙনে সব শেষ হওয়ার পর মায়ের সাথে থাকতো ঢাকার আমিন বাজারের অদূরে এক ঝুপড়ি ঘরে। বাবাকে চোখে দেখেনি সে। মা হোটেলে-হোটেলে পানি টানার কাজ করতেন। একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে চারপাশে অনেক মানুষের ভীড়। গাড়ি চাপায় রাস্তায় পরে আছে তার মায়ের ছিন্ন ভিন্ন শরীর। এরপর অনেকেই দয়া করে এটা ওটা খেতে দিতো। কিন্তু তা আর কতদিন? তারপর লেগুনায় হেলপার। একবার চলন্ত লেগুনা থেকে পা পিছলে পরে মারাত্ম আহত হয় ইদ্দিছ। এরপর সে আর কিছু বলতে পারে না। সূর্যডুবির পূর্ব মূহুর্তে অনেক মানুষজন জড়ো হয়েছে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের তরা কালীগঙ্গা নদীতে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে। খোড়াতে খোড়াতে দৌড়। টার্গেট, বেড়াতে আসা মানুষজনের কাছে দু’হাত পেতে কিছু নেওয়া। তা না হলে যে তার উপোস থাকতে হবে আরেকটি রাত।
এদিকে আতংক, অভাব ও চরম হতাশায় নির্ঘম সময় কাটে পদ্মা ও যমুনাপাড়ের সহস্রাধিক পরবিাররে। ঈদ উপলক্ষে ছিল না বাড়তি আয়োজন, ছিল না মনে আনন্দ। এমনই কঠিন পরিস্থিতিতে ঈদ কেটেছে মানিকগঞ্জের নদী পাড়ের বাসিন্দাদের। ঈদের দিনও ভাঙন তাড়া করে বেড়িয়েছে তাদের। কেড়ে নিয়েছে দু’চোখের ঘুম। ঈদ তাদের জন্য আনন্দের নয়; কবেলই বিবর্ণ বেদনার। হরিরামপুরের পদ্মার ভাঙনের অপেক্ষায় প্রতিক্ষারত রমেজ শেখ জানালেন, “ঈদের একটা দিন; পোলাপানের গতরে নতুন জামা দিতে পারলাম না। দিমু কেমনে, দু বেলা খাওনই জুটে না।”
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চরবারাঙ্গা গ্রামের প্রবীণ সমেজ প্রামাণিক। গত ২০ বছরে ৮ দফা ভাঙনের শিকার হয়েছেন। তার ৪০ বিঘা জমি ও ঘরবাড়ি ছিল। এখন কিছুই নেই, সবই যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। ইপিজেড এলাকায় কুলির কাজ করে চলে তার সংসার। তিনি জানান, নতুন জামা কাপড় তো দূরে থাক, ঈদে মুখে একটু ভালো খাবারও খেতে পারেননি। কথাগুলো বলার সময় ছলছল নয়নজুড়ে তরতর করে বেরিয়ে এলো তার ভেতরের চাপা কান্না।
হাকিম শেখ বসবাস করেন জেলা শহরের বেউথা এলাকায়। পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৫জন। পেশায় একজন ভ্যান চালক। বাড়িতে বৃদ্ধ মা ও প্রতিবন্ধি মেয়ে। এবারের ঈদ আয়োজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিছুটা থমকে যান। উৎসব আসলেই তার মনের মাঝে ভেসে ওঠে বৃদ্ধ মা ও প্রতিবন্ধি মেয়ের কথা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “ভাই ঈদের আর কি আনন্দ করবো বলেন? মা ও মেয়ের ঔষধ কিনতেই তো সব আয় শেষ হয়ে যায়। আমাদের ঈদ কিছু আনন্দ দিলেও কষ্টই হয় বেশি। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনসংযোগ করেন।
বালিয়াখোড়া এলাকার বিধবা মাজেদা বেগমের ঈদ কেটেছে একটি যাকাতের কাপড় পড়ে। স্বামী ও একমাত্র ছেলে প্রায় দুই যুগ আগে দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর স্বামীর ৩ শতাংশ ভিটে আকড়ে বেঁচে আছেন তিনি। করতেন মাটি কাটার কাজ। বয়স বেড়েছে, নানা রোগে-শোকে আক্রান্ত। এখন আর শরীরে শক্তি নেই কাজ করার। ঈদের দিন প্রতিবেশীরা খিচুড়ি আর সেমাই দিয়ে গেছে। তাই দিয়েই তার ঈদ উদযাপন।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকার আসাদুর রহমান পেশায় একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। থাকেন ঢাকার আশুলিয়া এলাকায়। ঈদ উপলক্ষে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে আসার সময় পড়েন সড়ক দূর্ঘটনায়। মারাত্মক আহত অবস্থায় ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার ১২ বছরের একমাত্র ছেলের। মাথায় আঘাত পাওয়া স্ত্রী চিনতে পারছেন না কাউকে। ছেলের পছন্দের জামা, প্যান্টে বারবার পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বিলাপ করছেন আসাদুর রহমান। এ পরিবারজুড়ে কেবলই কান্না আর আহাজারী। ঈদের দিন যেন তাদেও আরো কষ্টকে বাড়িয়ে দিয়ে গেল। এমনও হাজার পরিবার সড়ক দূর্ঘটনার কবলে পড়ে কান্নায় পাড়ি দেন ঈদ।
ঘিওর এলাকায় আব্দুল করিমের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি। আয়ের উৎস দৈনিক শ্রম বিক্রি। তাঁর ছোট মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর এবারই প্রথম ঈদ। তিনি বলেন “মেয়েকে ঋণ করে বিয়ে দেওয়ার পর আমার সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। যা আয় হয় পরিবারের খাওয়া খরচ আর কিস্তি দিতেই সব খরচ হয়ে যায়। ঘরে নতুন জামাই-মেয়ে আসছে। নিজেরা না নিলেও তাদেরকে তো নতুন কাপড় দিতে হয়েছে। তাই অন্য এক সমিতি থেকে আবার কিছু ঋণ করেছি। আমাদের তো আর ঈদ উপলক্ষে বাড়তি কোন আয় বা বোনাস নেই। ঈদের কয়দিন আবার কাজও কম পাওয়া যায়। আমাদের ঈদ কিছু আনন্দ দিলেও কষ্টই হয় বেশি।”
দেশে এমন অসংখ্যা মানুষ আছে যারা এখন দিন এনে দিন খাওয়ার মাধ্যমে দিনাতিপাত করেন। কাজ থাকলে ভাতের অভাব না হলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান তাঁদের কাছে প্রতিদিনের মতোই মনে হয়। ভাবনাতেও তাদের পরিবর্তন হয়না কখনোই। তবে সরকারসহ সমাজের বৃত্তশালী মানুষদের দ্বারা এসকল সুবিধা বঞ্চিত, প্রান্তিক আর দরিদ্র মানুষদের ঈদের মতো অনুষ্ঠানকে পরিণত করা যায় সার্বজনীন উৎসবে।