পিঠা, প্রকৃতি ও মায়ের জ্ঞান
ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার
মা তেলের পিঠা বানাতেন। তেলের পিঠাকে অনেকে পাকান বা পাকোয়ান পিঠা হিসেবে চেনেন। এটির অন্যকোন বিশেষ নাম আছে কী না- জানিনা? আমার খুব প্রিয় বলে পিঠা শুরুর একবারে প্রথম পর্যায় থেকে মায়ের সাথে লেগে থাকতাম। মা পিঠা বানানোর সাথে সাথে গরম গরম খেতে হবে। কিন্তু, মা কখনোই ১ম পিঠাটা দিতেন না। এমনকি ২য় এবং ৩য়টাও নয়। একবারে ৪র্থ পিঠাটা খেতে দিতেন। বেশ অবাক হতাম। মাকে জিজ্ঞেস করলে বলতো- প্রথম পিঠাটা চুলার, ২য়টা কড়াই (পিঠা তৈরির পাত্র) এর এবং ৩য়টা কেন রাখতো আজ মনে পড়ছে না। তার এই উত্তরে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারতাম না। কারণ যে বস্তুর জন্য এই পিঠাগুলো উনি রাখতেন। সেগুলো তো এই পিঠা খেতে পারে না। তাহলে তাদের জন্য এই পিঠা রাখার কারণ কী? পরে অবশ্য গরম গরম পিঠা নিয়ে মেতে থাকতাম। এই প্রথম ৩টি পিঠা রেখে দেয়ার পাঠোদ্ধার আর হতো না।
বিশ্ববিদ্যালয় এসে পরিচিত হলাম নতুন এক জ্ঞানকান্ডের সাথে। নাম তার ইন্ডিজেনাস নলেজ। বাংলায় লোকায়ত জ্ঞান বা স্থানীয় জ্ঞান। তবে এই জ্ঞানটা অনেক বেশি জটিল সংজ্ঞায়ন এবং স্বীকৃতি উভয়ের দিক থেকেই। যাই হোক, শিখেছিলাম আমাদের জীবনের বেশিরভাগ কাজেরই সাথে অর্ন্তভুক্ত রয়েছে কোন না কোন জ্ঞান। সেটি হতে পারে কোন কৌশল, তথ্য কিংবা অভিজ্ঞতা। আর প্রকাশ পায় বিশ্বাস আর কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সাথে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই জ্ঞানকে বর্তমান সময়ের আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষায় সেটি বুঝে ওঠা এবং সেটিকে ব্যাখ্যা করা অনেক সময় দুঃসাধ্য হতে পারে। তবুও এই জ্ঞানের রয়েছে স্থানিক স্বীকৃতি এবং গ্রহণযোগ্যতা। এই জ্ঞান মানুষ সাধারণত বংশপরম্পরায় কিংবা দীর্ঘ দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আত্মস্থ বা অর্জন করে থাকে।
অনেকদিন হলো মায়ের হাতের সেই তেলের পিঠা খাওয়া হয় না; খাওয়া আর সম্ভবও না। আর আমার যেহেতু প্রিয় তাই নিজেই বানিয়ে খাই। কিন্তু সেটা কখনো মায়ের বানানো পিঠার মতো হয় না। প্রতিবার বানানোর সময় লক্ষ্য করি প্রথমদিককার পিঠাগুলো সুন্দর হয় না। ফুলকো হয় না। কেমন যেন চিমটে হয়। ৩-৫টা পিঠার পরবর্তীগুলো তুলনামূলক ভালো হতে থাকে। তখন থেকে মায়ের ৩টা পিঠা না খেতে দেয়ার কথা মনে পড়ে গেল। অনেকবার ভাবলাম, তাহলে এটাই সেই কারণ। পিঠা তৈরির যে মিশ্রণ তৈরি করা হয় সেটি হয়তো ৩ টা পিঠা বানাতে যে সময় লাগে সেই সময়েল মধ্যে মিশ্রণটা তার আদর্শ অবস্থায় পৌঁছায়। কিংবা গরম তেল আর পিঠা তৈরি উপকরণ এর মধ্যে সহাবস্থান এর জন্য ঐ ৩টা পিঠা তৈরির সময়টুকু হয়তো লাগে। অথবা পিঠা যে সুন্দর হচ্ছে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতেন। কোন একটি উপকরণ হয়তো কমবেশি হয়ে গিয়েছে। ৩ টা পিঠা তৈরির মধ্যে দিয়ে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এবার হয়তো পিঠার মিশ্রণটা যথাযথ হয়েছে। এটাই কি তার প্রিয় সন্তানকে প্রথম ৩টা পিঠা খেতে না দেয়ার কারণ। আজকের এই উপলব্ধি মা’র কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো উত্তর মিলতো- কিন্তু সেটি আর সম্ভব না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটি শুধু আমার মায়ের ক্ষেত্রে নয়; অনেক মায়ের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতো। মায়েরা হয়তো পিঠা তৈরির পিছনের এই ঘটনা তার মা, শ্বাশুড়ি, দাদী কিংবা নানীর কাছে থেকে শিখেছেন। কিংবা তিনি দীর্ঘদিন ধরে পিঠা তৈরি করতে করতে এই ৩টি পিঠা তৈরি জ্ঞান নিজেই আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এই জটিল সমীকরণ তার শিশু সন্তানকে কিভাবে বুঝাবেন? তাই হয়তো এই রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। কিংবা হতে পারে এই ব্যাখ্যা আমার মায়ের কাছেও নেই। তিনি এই রূপক হয়তো তার মা এবং অন্যান্য পূর্বসূরীদের কাছ থেকেই শুনে এসেছেন। আর তিনি এভাবেই এই রূপক ব্যাখ্যাটাকে ‘রিলে রেসের’ মতো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বিলিয়ে দিচ্ছেন। রূপক যাইহোক, এর ব্যাখ্যাটা যদি আধুনিক জ্ঞানে যৌক্তিক হয় তবে সেটি সত্যিই একটি জ্ঞান সমৃদ্ধ শিল্প। বিশেষ করে এই জটিল সমীকরণকে এতো সহজ এবং সরল ভাষায় একটা রূপকের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার বিষয়ে। আর পিঠা তৈরি যে একটি জ্ঞান এবং দক্ষতা সেটি তো প্রশ্নাতীত।
এই তেলের পিঠা তৈরির একটি অন্যতম সময় হচ্ছে হেমন্তকাল। নবান্নের সময়। নতুন চালের গুড়ি আর খেঁজুড়ের রস দিয়ে তৈরি গুড়। এটি না হলে এই পিঠা তৈরি সম্ভব না বলে মায়ের বিশ্বাস ছিল। গুড়ের বদলে চিনি দিলে পিঠার রঙ, স্বাদ এবং বর্ণ আদি পিঠার মতো হয় না। তালের রসের গুড় কিংবা অন্য রসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার যে কোন চালের গুড়া হলে হবে না। পিঠা তৈরি জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট ধরনের চাল। দেখতাম বাবা জমির একটি ছোট অংশে ঐ ধান রোপণ করতেন। বলতে লজ্জা হচ্ছে, আমি সেই নির্দিষ্ট প্রজাতির ধানের নাম মনে করতে পারছি না। অন্যদিকে চালের গুড়ার তৈরির জন্য প্রয়োজন ঢেঁকি। মেশিনের চালের গুড়া তো কখনোই নয়। এখন আর বাসায় তেলের পিঠা হয় না। মা এর সাথে সাথে এই পিঠা হারিয়ে গেছে আমাদের পরিবার থেকে। হারিয়ে গেছে মা’র পিঠা কেন্দ্রিক জ্ঞান। এখন আর কেউ তেলের পিঠা বানায় না। আর হঠাৎ কখনো বানালেও নেই সেই আগের কোন উপকরণই। বাজার থেকে কিনে আনা ময়দা কিংবা চালের গুড়া, চিনি বা গুড় দিয়ে কোন রকমে হলেই হলো। প্রথম ৩টা পিঠা খেতে দেয়ার সেই চলও আর নেই।
আমাদের মায়েরা বিশেষ করে গ্রামের মায়েরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের জ্ঞানকে লালন করে আসছেন। তাদের সেই জ্ঞানের প্রতিটি স্তরের সাথে জড়িত রয়েছে প্রকৃতির এক একটি উপাদান। সময়ের পরিক্রমায় যদিও তাদের সেই জ্ঞান এবং প্রকৃতির উপাদানগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের শুন্যতা। জ্ঞান এবং প্রকৃতির সম্পর্ক এক অন্যের পরিপূরক। এই তেলের পিঠা ক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রকৃতির দুটি উপাদান। একটি সুনির্দিষ্ট প্রজাতির ধান আর খেঁজুর রস দিয়ে তৈরি গুড়। এই ২টি উপাদানই বাড়িতে উৎপাদিত এবং প্রক্রিয়জাত হতো। কোনভাবেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ধান রোপণ থেকে শুরু করে চালের গুড়ি তৈরি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই থাকতো মায়েদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আর প্রতিটি স্তরে স্তরে যে অলিখিত, অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকতো সেটি তো বলার অপেক্ষা রাখেনা।
অন্যদিকে খেঁজুর রসের গুড়ও ছিল বাড়িতে তৈরি। বাড়িতেই উপাদিত হতো বাড়ির খেঁজুর গাছ থেকে সংগৃহিত রস থেকে। সেই রস থেকে গুড় তৈরি এবং বছর ধরে সংগ্রহের প্রতিটি ধাপেই মায়ের জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই থাকতো। কিন্তু তার অনুপস্থিতি একটি পরিবারে এই তেলের পিঠা কেন্দ্রিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন শূন্যতা তৈরি করেছে। ঠিক তেমনই প্রকৃতির এই ২টি উপাদানও হারিয়ে গেছে একটি পরিবার থেকে। অনেক ক্ষেত্রে এর উল্টাও হয়। দেখা যায় প্রকৃতির ঐ দুটির কোন একটি উপাদানের বিলুপ্তির ফলেও এই জ্ঞান ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে পারে।
একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের স্থানীয় জ্ঞানের সাথে প্রাণ এবং প্রকৃতির সম্পর্ক অবেচ্ছেদ্য। একটি ব্যতিরেকে অন্য একটি টিকে থাকতে পারে না। তাই যদি জ্ঞানটিকে প্রাধান্য দিতে চাই তাহলে প্রকৃতির উপাদানগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। অথবা প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট্ জ্ঞানটাকেও চর্চা, গুরুত্ব এবং স্বীকৃতি দিতে হবে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত আচরণ আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সেকেলে, প্রতিক্রিয়াশীল মনে হলেও এই পৃথিবীর স্থায়িত্বশীলতার জন্য এর বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেয়ার জন্য স্থানীয় সংস্কৃতি এর সাথে সংশ্লিষ্ট লোকায়ত জ্ঞান এবং প্রকৃতির উপাদানগুলোর এই মেল বন্ধন অত্যন্ত জরুরি।