অগ্রহায়ণের ফসল ঘরে আসে নানান রীতি রেওয়াজের সমারোহে
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
কৃষি প্রধান আমাদের এই দেশে কৃষিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে নানান রীতি, রেওয়াজ এবং আচার অনুষ্ঠান, যা গ্রামাঞ্চলের প্রাণ, বিনোদনের খোরাক, স্থানীয় সংস্কৃতির সম্পদ ও গ্রামীণ জীবনেরই একটি অংশবিশেষ। অগ্রহায়ণের ফসল কৃষককে শুধুমাত্র নতুন ধান পাওয়ার আনন্দকেই বাড়িয়ে দেয়না সেই সাথে কৃষির সাথে আত্মিক সম্পর্ককেও সূদৃঢ় করে। যদিওবা সেইসব সংস্কৃতির অধিকাংশই এখন শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে রয়েছে। আর যতটুকুও চর্চা আছে সেটাও নির্দিষ্ট কিছু এলাকার নির্দিষ্ট কিছু গোত্র বা সমাজ কিংবা নির্দিষ্ট কিছু বড় কৃষক পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অগ্রহায়ণের ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে যেসব আচার অনুষ্ঠান এখনও চর্চা করছেন তা তুলে ধরা হল।
আদিবাসী হাজং সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠান
আদিবাসী হাজং সম্প্রদায় অঘ্রাণের ফসলকে কেন্দ্র করে যেসব আচারানুুষ্ঠান পালন করেন সেই সম্পর্কে লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের নয়নকান্দি গ্রামের ভরত হাজং (৭২) জানান, আশ্বিন মাসের শেষ থেকে কার্তিক মাসের প্রথমদিকে ধানের জমির আইলে কূপি বাতি জ্বালান এবং জমির এক কর্নারে একটি কলাগাছ স্থাপন করে খই, চালের গুড়ি, কলা, চিনি দিয়ে পূজা অর্চনা করেন গ্রহ নক্ষত্রদের জাগ্রত করার উদ্দ্যেশ্যে এবং ফসলের শুভ কামনায়। ধানের জমিতে মুড়ি ছিটিয়ে দেন যেন থোর বের হওয়া ধানের সবগুলোই পুষ্ট হয়। এদিন থেকেই তাদের গ্রামের প্রত্যেক হাজং পরিবার এক মাস যাবৎ প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নিজ নিজ বাড়ির আঙিনার এক পাশে বাঁশের সাথে বাতি বেঁধে অনেক উচুতে আলো জ্বালিয়ে রাখেন। অতঃপর কার্তিক মাসের শেষ দিন বাতি নামানো হয় এবং এদিন খড় দিয়ে তৈরি করা মশাল জ্বালিয়ে কার্তিক মাসকে বিদায় জানান এবং অগ্রহায়ণকে আমন্ত্রণ জানান। কার্তিক মাস যায় অগ্রহায়ণ মাস আসে, মশার মুখ পোড়া যায় বলে চিৎকার করতে করতে ছোট ছোট শিশু কিশোরেরা সন্ধাবেলা এদিক ওদিক দৌড়ান। ভরত হাজং বলেন, “ধান কাটার আগে আমরা পঞ্জিকা দেখে দিন নির্ধারণ করি। অতঃপর ধান কাটার ঠিক আগের দিন চালের গুড়ি, ঘি, কলা, চিরা, মধূ, চিনি, গুড়, দুধ, নারকেল দিয়ে জুস তৈরি করে তা বিন্নি চালের মুড়ির সাথে মেখে ফসলের জমিতে ভোগ দিই। তবে শনিবারে কোন গৃহস্থ ধান কাটেন না। গৃহস্থের অকল্যাণ হবে বলে।”
মুসলিম সম্প্রদায়ের ধানের আগ কাটা আচারানুষ্ঠান
ধানের আগ কাটা আচারানুষ্ঠান সম্পর্কে খারনৈ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের জোবেদা খাতুন (৬৭) জানান, ধান কাটার আগে গৃহস্থ ‘বার’ হিসাব করে। শনিবারে ধান কাটেনা। ধান কাটার আগে ঘর লেপেন। তারপর গৃহস্থ ঘরের যে ব্যক্তি ধান কাটতে যাবে সে গোসল করবে। কারো সাথে কথা বলতে পারবেনা। তারপর জমিতে গিয়া জমির এক কর্নারের এক গোছা ধান কেটে নতুন গামছা দিয়া মুড়িয়ে মাথায় করে ধান ঘরে নিয়ে আসে। তবে ধান নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা (মা, ভাই, বোন) তার পা ধোওয়াইয়া দিবে।” তিনি আরও বলেন, “এরপর ধানের গোছাটি ঘরের মাঝখানের পাল্লার সাথে বেঁধে রাখবে পরবর্তী ফসল না আসা পর্যন্ত। এই গোছাঁর ধানগুলো পরবর্তীতে ইদূর, বাদুর ও পাখি খেয়ে শেষ করে। তবে এই গোছার ধানটি ঔষধি কাজে লাগে।” তিনি জানান, কারো চোখের ভেতর ময়লা বা কোনকিছু প্রবেশ করলে এই ধানের কয়েকখন্ড চালের টুকরা চোখের কোনায় রেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করলেই ময়লাগুলো বের হয়ে যাবে। এ আচারানুষ্ঠানাদি পালন শেষে অন্যান্যদের দিয়ে জমির ধান কাটানো হয়। ধান কাটা শেষ হলে পর প্রথম কাটা ধানের চাল ও মাছ, মাংস দিয়ে মসজিদের হুজুরের জন্য খাওয়ান এবং পরে মসজিদে অবস্থানরত অন্যান্যদের জন্যও খাওয়ান।
হিন্দু সম্প্রদায়ের আচারানুষ্ঠান
কলমাকান্দা উপজেলার পোগলা ইউনিয়নের পনার পারুয়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় অঘ্রানের ফসলকে কেন্দ্র করে যেসব রীতি রেওয়াজ পালন করেন সেই সম্পর্কে মলি দত্ত (৩০) বলেন, “আমাদের গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকগণ ধান কাটার আগে পঞ্জিকা দেখে দিন নির্ধারণ করেন। পরে ফসল ঘরে তোলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ধান কাটার আগের দিন ঘর লেপেন। এরপর ঘরের মাঝখানে পানি, তিল, বেলপাতা, হরতী, তুলীপাতা, পাঁচটি পাতাযুক্ত আমের পল্লব, দূর্ব্বা, ধান দিয়ে ঘট স্থাপন করেন। ঘটে পাঁচ ফোঁটা সিদূর ও আমের পাঁচটি পাতায় সিদূরের ফোঁটা দেয়া হয়।” তিনি আরও জানান, এরপর গৃহস্থ জমি থেকে এক গোছা ধান কেটে নিয়ে এসে ঘরের মধ্যম পাল্লায় কাঁচিসহ বেঁেধ রাখেন। স্থাপতি ঘটটি সারাদিন সারারাত রেখে পরের দিন বিসর্জন দেয়া হয়। তবে যে গৃহস্থ ধান কাটবেন তাকে সকালবেলা উপবাস থাকতে হয়। দূপুরের পর তাকে ৫-৭ ধরনের তরকারি দিয়ে খাবার দেয়া হয়। সেই সাথে পিঠা পায়েসও দেয়া হয়। এইসব আচার অনুষ্ঠান পালন শেষে পরের দিন থেকে শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটানো হয়। ধান মাড়াই হওয়ার পর বুধ ও বৃহস্পতিবার ধান শুকানো হয়। এরপর কোলায় সিদূরের ফোঁটা ও দূর্ব্বা দিয়ে গোলায় ধান তোলা হয়। ঐদিন কোলাটি গোলায় রেখে দেয়া হয়। পরের দিন সেই কোলা গোলা থেকে নামানো হয়। তবে যে মাসে ধান গোলায় তোলা হয় সেই মাসে আ গোলা থেকে ধান নামানো হয় না।
আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের আচারানুষ্ঠান
আদিবাসী গারো সম্প্রদায় অঘ্রানের ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে যেসব আচারানুষ্ঠান পালন করতো তা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানান লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের তারানগর গ্রামের আয়েশা রংদী (৮০)। তবে এক সময় তারা যা করতেন সেই সম্পর্কে তিনি জানান, প্রথম ধান শ্রমিকদের দিয়ে কাটানোর পর শ্রমিকরা জমির এক কর্নারে কিছু পরিমাণ ধান রেখে আসতো। পরে সন্ধা বা বিকেল বেলা জমির মালিক ধানটি কেটে নিয়ে আসতো এবং নতুন গামছা দিয়ে ধানের আটিটি মুড়িয়ে মাথায় করে গোলাঘরে রেখে দিতো। যা বীজ হিসেবে সংরক্ষিত হতো। এছাড়াও গারোরা ওয়ানগালা ও রংচুগালা নামক অনুষ্ঠান করে দেবতা মিসি সালজং-এর উদ্দেশ্যে ফসল উৎসর্গ করতো। যা বর্তমানে খুব বেশি আর চর্চা হয়না। শুধুমাত্র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় বিনোদনের অংশ হিসেবে ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। তবে রবিবারে গীর্জায় গীর্জাঘরে সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদে ভালো ফসল লাভের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যীশু খ্রীষ্টের উদ্দেশ্যে কিছু পরিমাণ ধান ও অন্যান্য ফসল উৎসর্গ করে থাকেন ।
কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে খারনৈ ইউনিয়নের রানীগাও গ্রামের জগদিস হাজং (৭০) বলেন, “আগেকার মানুষের অনেক জমি জমা ছিল। আগে মানুষ যৌথ পরিবারে বাস করতো। এই কারণে জমিগুলো একটি পরিবারের মধ্যে ছিল। বর্তমানে পরিবারগুলো ভাগ হইয়া যাইতাছে। অল্প জমির জন্য মানুষ এত আচার অনুষ্ঠান পালন করার প্রয়োজন বোধ করেনা।” এছাড়াও গারোদের মধ্যে সাংসারেক ধর্ম পালনকারী না থাকাতে এই আচার অনুষ্ঠানগুলো পালন হয় না বলে জানান সাবিনা রংদী (৬৫)।
যেসব কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ এবং যেগুলো এখনো চর্চায় আছে সেগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত বলে তথ্যদাতারা দাবি জানান।