চলনবিল এলাকায় বাড়ছে কেঁচো কম্পোস্ট-এর ব্যবহার, উপকৃত কৃষক
:: চলনবিল এলাকা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
আদিম ও গতিময় বিজ্ঞান কৃষি। পৃথিবীর উপরিভাগ অর্থাৎ মাটি কর্ষণ করে কৃষক যে ফসল উৎপাদন করে তা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। দিনের পর দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ অধিক ফসল উৎপাদনের চিন্তা, চেষ্টা করছে। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি প্রযুক্তি বদলাচ্ছে। কিন্তু বার বার মাটি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করায় মাটি তার প্রাণশক্তি, উর্বরাশক্তি হারাচ্ছে। মাটির উর্বরা শক্তি বাড়াতে, ফসল উৎপাদন বাড়াতে মাটিতে অধিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে একদিকে পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি মাটি তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। এছাড়া আমাদের সচেতনতার অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত মাটি দূষণ করে চলেছি। মাটি নিয়ে ভাবেন, মাটি নিয়ে চিন্তা করেন চলনবিল এলাকার এমন কিছু মানুষ সম্প্রতি নিজ উদ্যোগে জৈব কৃষি প্রযুক্তি কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। বিপ্লব সরকার, আবুল হাশেম এবং আজাহার আলীরা চেষ্টা করেছেন মাটির স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে। এ কারণে তারা জৈব কৃষি চর্চার দিকে নিজেদের মনোনিবেশ করছেন।
জৈব কৃষি প্রযুক্তির প্রতি কৃষকের আগ্রহ
জৈব কৃষি চর্চায় কেন আগ্রহী হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে চলনবিল এলাকার বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গরমাটি গ্রামের মৃত বাদল সরকারের ছেলে বিপ্লব সরকার বলেন, “১৪ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকে। ফালা করে হাটে হাটে তরমুজ বিক্রি করতাম। কিছু টাকা জমিয়ে অন্যের জমি লীজ নিয়ে সবজির আবাদ শুরু করি। সবজির আবাদ করার সময় দেখলাম, যে জমিতে জৈব সার দিতে পারছি সে জমিতে ভালো ফসল ফলছে। আর যে জমিতে জৈব সার দিতে পারিনি সে জমিতে ভালো ফসল ফলছে না। তখন থেকেই জমি চাষে জৈব সারের গুরুত্ব উপলব্ধি করি।” তিনি বলেন, “এরপর থেকে টাকা জমিয়ে নিজ উদ্যোগে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি শুরু করেছি। একই গ্রামের হাশেম আলী জানান, দীর্ঘদিন যাবত শিমসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করে দেখেছেন যে, জৈব সারের ঘাটতি হলে ভালো ফসল উৎপাদন হয় না। তাই কেঁচো সার তৈরি করার কথা মাথায় আসে তার।
আবুল হাশেম চাপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে ছাদেক আলী নামে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করার কৌশল শিখেছেন। তার বন্ধু ছাদেক আলী দীর্ঘদিন যাবত কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে আসছেন। কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে ছাদেক আলী লাভবান হচ্ছেন বলে আবুল হাশেম জানান। এতে অনুপ্রাণীত হয়ে আবুল হাশেম নিজেও ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ঘর নির্মাণ করে ঘরে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির কয়েকটি চেম্বার করেছেন। দুই লাখ টাকায় একলাখ কেঁচো কিনেছেন। চেম্বারে গোবর, কচুরিপানা, পাতা, খড়কুটো দিয়ে সেখানে কেঁচো ছেড়েছেন। তাঁর এ কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির করার ঘর উদ্বোধন করেছেন বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ।
অন্যদিকে বিপ্লব সরকার জানান, পরিচিত ব্যাংক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম তাঁকে কেঁচো সার উৎপাদনে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, “প্রথমদিকে খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও কিছুদিন পূর্বে হাশেম ভাইয়ের সাথে ভোলা হাটে গিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন দেখে আমার আগ্রহ বাড়ে। আমি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। এভাবে ৭০ হাজার টাকা খরচ করে ২২ ফিট বাই ১৬ ফিট ঘর তৈরি করি। ১০ ফিট বাই সাড়ে ৩ ফিট সাইজের ৮টি চেম্বার তৈরি করি।” ব্যক্তি উদ্যোগে তিনি প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ করেছেন এই কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। গত ২৭ নভেম্বর মেহেরপুর জেলার আমঝুপি গ্রামের শওকত আলীর নিকট থেকে দেড় লাখ কেঁচো এনে চেম্বারে রক্ষিত ২ মাস বয়সী গোবরের মধ্যে ছেড়েছেন। তিনি আশা করছেন খুব শিগগিরই তিনি কেঁচো সার উৎপাদন করতে পারবেন। তার ভাষ্যমতে, প্রথম অবস্থায় সার তৈরি হতে প্রায় দুই মাস সময় লাগবে। এরপর দেড় মাস এবং তারপর প্রতিমাসে একবার করে চেম্বার থেকে চায়ের পাতির মতো গন্ধবিহীন কেঁচো সার সংগ্রহ করা যাবে বলে তিনি জানান। এলাকায় কেঁচো সার ৮শ টাকায় মণ বিক্রি হয়।
এছাড়া মাটির উর্বরাশক্তি বাড়াতে চলনবিলাঞ্চলের চাটমোহরের বাহাদুর পুর গ্রামের আজাহার আলী দীর্ঘদিন যাবত বাড়িতে জৈব সার তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করে আসছেন। এতে তার জমির ফসল ভালো হচ্ছে বলে জানান তিনি। তার দেখাদেখি এ গ্রামের সুলতান মোল্লা, জোনাব আলী মোল্লাসহ প্রায় আরো ২০ জন কৃষক গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করছেন। এই প্রসঙ্গে আজাহার আলী বলেন, “এ সার তৈরির জন্য আমি বড় গর্ত করে সেখানে গোবর, ছাই, খরকুটো, ধানের চিটা রেখে দিই।” বিশেষত বর্ষাকালে যখন গোবর শুকিয়ে জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব হয় না সেসময়ে গোবর কম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করেন তিনি।
মাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে
কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির জন্য আবুল হাশেম ও বিপ্লব সরকাররা অনেক টাকা খরচ করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মাটিকে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি। রাসায়নিক সার মাটির স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই মাটিকে রক্ষা করতে হবে। বিপ্লব সরকার বলেন, “আমি আসলে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ কাজ শুরু করিনি। যে মাটি আমাদের মা সেই মায়ের প্রতি ভালোবাসার তাগিদে এই কাজ করেছি।” তিনি আরও বলেন, “মাকে ভালো রাখতে আমি এ কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি।” তিনি মনে করেন, তিনি যা খরচ করেছেন তা একদিন না একদিন এর ফল পাবেনই। এছাড়া সফলতা পেলে তিনি অন্যকেও এ সার তৈরির প্রযুক্তি শিখাবেন। তাঁর দেখাদেখিতে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হলে এবং জৈব কৃষি চর্চা করলে দেশ বাঁচবে, মাটি বাঁচবে, বাঁচবে ভবিষ্যত প্রজন্ম বলে তিনি মনে করেন।
কম্পোস্ট সার ব্যবহারের উপকারিতা
জৈব সার হচ্ছে কেঁচো এবং বিভিন্ন প্রকারের অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, কৃমি, এ্যাক টিনোমাইসিটিস) দ্বারা সংঘটিত জৈব পদার্থের (উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ) পচনক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন সার, যা পচনক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে জৈব পদার্থ হিউমাসে পরিণত হয়। হিউমাস গাছের খাদ্য উপাদান মজুদ রাখে যা থেকে গাছ প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে থাকে। কম্পোস্টের মধ্যে তাপের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, অণুজীবগুলো পচনক্রিয়া সংঘটিত করেছে। সাধারণত শুকনো গাছপালা, লতাপাতা, খড়, সবুজ লতাপাতা যেমন কচুরিপানা, সবুজ ঘাস, সতেজ পাতা, আগাছা, শিম জাতীয় গাছ বা গাছের পাতা, পশু পাখি প্রাণীর মলমূত্র, অণুজীবের উৎস হিসেবে ভালো মাটি বা গোবর, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। কম্পোস্ট ব্যবহারে মাটি নরম হওয়ায় মাটি কর্ষণ সহজ হয়, মাটিতে শিকড়ের চলাচল সহজ হয়। মাটিতে বায়ু চলাচল করতে পারে বিধায় মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। কম্পোস্ট মাটিতে থাকা খনিজ পদার্থকে দ্রবীভূত করে। অণুজীব সৃষ্টি, বৃদ্ধি করে যা দীর্ঘ সময় মাটির উর্বরতা ধরে রাখে। কম্পোস্ট ক্ষার মাটির পিএইচ কমায় এবং অম্ল মাটির পিএইচ বাড়ায়। চাটমোহর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রওশন আলম বলেন, “আমাদের মাটি রক্ষায়, ভালো ফসল উৎপাদনে কম্পোস্ট সার ভূমিকা রাখছে। চলনবিল এলাকার কিছু কৃষক যাদের গরু বাছুর আছে তারা গোবর কম্পোষ্ট তৈরি করেন। আমরা কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করতে কৃষকদের উৎসাহিত করছি।”