আমরাই পারি

সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বাবলু জোয়ারদার

প্রচলিত বা লোকগাঁথা নয়, চির সত্য বাস্তব যার উপর ভিত্তি করে বর্তমানে গ্রামটির নাম বড়িগোয়ালিনী। বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের নামানুসারে ইউনিয়নের নাম হয় বুড়িগোয়ালিনী। এই গ্রামে পদধূলি পড়েছে নানান মানুষের। সভ্যতার ছোঁয়া যখন রেনেশাঁস, তখন শুরু হয় জংগল আবাদ করে মানুষের বসবাস। এই প্রসংগে লিলাপদ মাঝী(৭৯) বলেন, ‘এই এলাকা ছিল গভীর বনে আবৃত। কথিত আছে এক বৃদ্ধা জংগলে বাস করতেন। তখন বর্তমান গ্রামটিতে ছিলো গভীর জংগল। জমিদারী নির্দেশে অনুসারীরা তাদের অধিকাংশ কর্মচারীরা আবাদ করতে এসে বুড়িমার সাথে সাক্ষাত হয়। বুড়িমার সাথে তারা বন আবাদের কথা বলেন, কিন্তু উনি এই কথা শোনার পর কয়েক‘দিন বন আবাদ করতে আসা লোকদের সাথে কথা বলেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তীতে কুকুডাংগা এলাকার মোংলাস ফঁকিরকে ডেকে বুড়ীমা তার আরোদ্ধ স্থানে কালীথান ও আলীমদন থান প্রতিষ্ঠা করে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে বলেন, আমি গোয়ালিনীর মেয়ে আবাদ করা এই জায়গার নাম রাখিস বুড়িগোয়ালিনী এবং এখানে একদিন মানুষের বসবাস হবে সেজন্য খাবার জলের জন্য একটি পুকুর খনন করিস এবং খননকৃত পুকুরের নাম রাখিস বুড়িগোয়ালিনী পুকুর। সেখান থেকে এই পুকুর খনন অনুমান করা হয়। আজও এখানে সেই আলীমদন থানÑকালীমন্দির জাগ্রত। তৎকালীন সময়ের মত মানুষের বিশ্বাস নিয়ে প্রতিষ্ঠান।

আবাদ করার পর এলাকায় লোকজনের বসবাস শুরু হলে আশেপাশের অন্য এলাকা/গ্রামের আবাদচ-ীপুর, তালবাড়ী, আড়পাংগাশিয়া, মাঝের আইট, পানখালী, বিলআইট এক কথায় এলাকার সমস্ত গ্রামের মানুষ এই পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল ছিল বলে জানা যায়। এই পুকুরের পানি কখনো শেষ করা যেতনা। একটা পুকুরের পানি দিয়ে আশে পাশের সমস্ত এলাকার মানুষের পানির অভাব পূরণ হতো।
দীর্ঘদিন এই পুকুর থেকে পানি সংগ্রহের পর বুড়িগোয়ালিনী গ্রামসহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন পানির চাহিদাও বেড়ে যায়। প্রয়োজন পড়ে পুকুর পুনঃসংস্কার করার। বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের তখন প্রথম নির্বাচিত মেম্বার অধির চন্দ্র মাঝী। তিনি এলাকার মানুষের চাহিদা ও চাওয়ার ফলে তিনি প্রথম পুকুর পুনঃসংষ্কার করেন। এই গ্রামের আরেক কৃতি সন্তান জীতেন্দ্র নাথ মল্লিক ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বার পুকুর পুনঃসংস্কার করেন।
আস্তে আস্তে পকুরটি আবারও পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে নানা প্রতিকূলতার কারণে এলাকায় আশে পাশের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায় এবং নদীর পানির উচ্চতাও বেড়ে যায়। ফলে পুকুর সংরক্ষণের বাঁধ দিয়ে খাবার পানির পুকুরে লবণ পানি প্রবেশ করে পানিতে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে এলাকায় পানির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তখন এলাকার যুব সমাজসহ গ্রামের বসবাসকারী মানুষেরা পুকুরটি পুনঃসংস্কারের জন্য আলোচনা শুরু করেন। বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের কিছু মানুষ বারসিক’র কাছে পুকুর পুনঃসংস্কার কাজ করার জন্য পরামর্শ নিতে আসেন কারণ বারসিক এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে আসছে। তখন বারসিক থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় স্থানীয় সরকারসহ উপজেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদকে আবেদন দেওয়া এবং মানববন্ধন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেইসাথে বারসিক থেকে আবেদন লিখে সহযোগিতা করা হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্থানীয় জনগোষ্ঠি নারী পুরুষ মিলে পুকুর খনন ও খেলার মাঠ তৈরি করার জন্য মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন এবং মানববন্ধন শেষে স্থানীয় জনগোষ্ঠি বিশেষ করে নারীরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার ও জেলা পরিষদ পুকুরটি পুনঃসংস্কার করার জন্য এগিয়ে আসেন। আলোচনা ও স্মারকলিপি দেওয়ার পর জেলা পরিষদ থেকে পুকুরটি পুনঃসংস্কার ও পুকুরের চারপাশে বেড়া দেওয়া এবং স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পুকরের পাশে চর ভরাট করে এলাকার যুবদের খেলার মাঠ তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইসাথে বারসিক’র কাছে পুকুরের পাড়ে লাগানোর জন্য কিছু গাছের চাহিদা জানান। চাহিদার প্রেক্ষিতে বারসিক ও সামাজিক বনবিভাগের সহয়তায় পুকুরের পাড়ের গাছের ব্যবস্থা করে। নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের দাবি পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর পরপরই একটি বেসরকারী সংগঠন পানি বিশুদ্ধ করার জন্য পুকুরের পাড়ে একটি আধুনিক সৌরবিদ্যুৎ চালিত পানির ফিল্টার তৈরি করতে সহযোগিতা করেন। স্থানীয় জনগোষ্ঠি একতাবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার ও দাবি আদায় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং তারা উপলদ্ধি করেছেন সমস্যা আমাদের সমাধান ও করতে হবে আমাদের।
জেলা পরিষদ ডালিম কুমার ঘরামী এই প্রসংগে বলেন, ‘পুকুরটি আমাদের এলাকায় পুরাতন পুকুর। দীর্ঘদিন ধরে এই পুকুর থেকে মানুষ পানি সংগ্রহ করে ব্যবহার করছে। পুকুরটি পুনঃখনন করা হলে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের খাবার পানির উৎস সংরক্ষতি হবে এবং খাবার পানির অভাবও পূরণ হবে।


বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘স্থানীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে একত্রিত হয়ে অধিকার আদায়ে যে ভূমিকা রেখেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমিও চাই আমার এলাকার সবাই একত্রিত হয়ে থাকুক এবং নিজেদের অধিকার বুঝে নিক। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা যতটুকু পারি তাদের সাথে থাকবো।
স্থানীয় জনগোষ্টি নিজেদের সমস্যা বুঝে সমাধান করতে এগিয়ে এসেছেন এবং সমাধানও করেছেন। একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছেন। জননেতৃত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের সর্বজনীন পুকুর পুনঃখনন।

happy wheels 2

Comments